গোটা দক্ষিণবঙ্গ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সালাম জানাল ওঁদের।
ঋতুপর্ণা দাস, মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান, রুকসানা খাতুন আর প্রবীর ভৌমিক। ক্রীড়া, সাহসিকতা, শিক্ষা আর চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁরা যে নজির গড়েছেন, এ যেন তারই পুরস্কার।
তাঁরা অতি সাধারণ। কিন্তু অসাধারণ হয়ে উঠেছেন সমাজের প্রতি নিজেদের কর্তব্যে। তাঁদের বেছে নিয়েছেন ‘অফিসার্স চয়েস আনন্দলোক সালাম বেঙ্গলে’র চার বিচারক অগ্নিমিত্রা পল, স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, অভিরূপ সরকারেরা। সাধারণদের অসাধারণ হয়ে ওঠার গল্প বলতে গিয়ে মুগ্ধ চার বিচারকই। প্রত্যন্ত গ্রামের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা এই প্রতিভাদের খুঁজে বের করতে পেরে তাঁরা গর্বিতও। অভিরূপ সরকার তো প্রশ্নই তুললেন, “এই চার জনের অসাধারণত্ব বিচারের যোগ্যতা আমাদের আছে তো?”
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বর্ধমানের সংস্কৃতি লোকমঞ্চ গানে গানে স্বাগত, সম্মান জানাল এই চার জনকে। ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা এই মুহূর্তে লখনউ-এ প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। তাই তাঁর বদলে বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মীনার হাত থেকে মানপত্র আর সালাম বেঙ্গল ট্রফি নিলেন দিদি সুপর্ণা। ভিডিওতে উপস্থিত ঋতুপর্ণার গলায় তখন আত্মবিশ্বাসের সুর। বলল, “নিজেকে যতটা পারি এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। গোপীচাঁদ অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আপনাদের আশীর্বাদ থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভাল ফল করবই।” মঞ্চের নীচে তখন মেয়ের সাফল্যে গর্বিত মা ও কাকার চোখ ছলছল। |
পশ্চিম মেদিনীপুরে পাথরা গ্রামে রয়েছে প্রচুর প্রাচীন মন্দির। এক সময়ে সে সব রক্ষণাবেক্ষণের কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। চার দশক আগে একাই এ সব মন্দির রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন তরুণ ইয়াসিন। শেষে তাঁর প্রচেষ্টায় মন্দিরগুলি রক্ষা পেলেও বার বার নিগৃহীত হতে হয়েছে তাঁকে। এ দিন ইয়াসিন বলেন, “বাবরি মসজিদ ভাঙার পরের দিন আমার উপরে এক দল লোক চড়াও হয়ে আমাকে প্রচণ্ড মারতে থাকে। ওরা সে দিন বলছিল, ওরা আমাদের মসজিদ ভাঙছে। আর তুমি ওদের মন্দির বাঁচাচ্ছ!” হার্ট, কিডনির অসুখের চিকিৎসায় মহম্মদ ইয়াসিন পাঠান এখন সকলের দরজায় ঘুরছেন সাহায্যের প্রার্থনায়। সাহসিকতার জন্য তাঁর হাতে এ দিন মানপত্র ও ট্রফি তুলে দেন বর্ধমানের পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর।
শিক্ষার জগতে এই সন্ধ্যায় পুরস্কার জিতেছেন আর এক সাহসিনী। পশ্চিম মেদিনীপুরের চৈতপুরের এই বাসিন্দার নাম রুকসানা খাতুন। প্রচণ্ড অভাবের সঙ্গে লড়ে সে এখন স্বপ্ন দেখছে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার। মাধ্যমিকে স্টার পাওয়া রুকসানা বলেছে, “আমার বয়স যখন মাত্র আট, তখন আমার আব্বা মারা যান। ক্লাস ফাইভে ভর্তি হতে আমার তখন দরকার ছিল মাত্র ৩৫ টা টাকা। সেটাও আমার মায়ের কাছে ছিল না। কাঁদতে কাঁদতে যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছি, তখন এক প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন। তিনিই টাকা দিয়েছিলেন। এখন তো আমার পাশে অনেকে আছেন।” পেন কেনার টাকাও অনেক সময় থাকে না তার কাছে। তবু লড়েই চলেছে রুকসানা।
সময়ের আগে পৃথিবীর আলো দেখে ফেলা শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য নিরলস লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কোলাঘাটের চিকিৎসক প্রবীর ভৌমিক। সালাম বেঙ্গলে সম্মান পেয়ে এ দিন মঞ্চে তিনি বলেন, “কলকাতার বাইরে অপরিণত শিশুদের চিকিৎসা সহজ ছিল না। অনেক দামি যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীর দরকার। শেষে নিজেই তৈরি করে নিলাম যন্ত্রপাতি। প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করলাম এক ঝাঁক কর্মী। আমাদের ছোট্ট হাসপাতাল তার পর বহু বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। সন্তানকে তাঁদের কোলে ফিরিয়ে দিয়েছে।”
এই অনুষ্ঠানে দর্শকদের বাড়তি পাওনা ছিল ইন্দ্রাণী সেন আর রাঘব চট্টোপাধ্যায়ের গান। তবু দিনের শেষে দর্শকদের মন ভরে রইলেন ইয়াসিন, রুকসানারাই। |