মন্দির রং করা থেকে পুজোর জল আনা, সবই করেন। তবু দেবী এলেই ওঁরা ‘ব্রাত্য’।
কারণ, ওঁরা অব্রাহ্মণ।
প্রায় একশো বছর আগে কেতুগ্রামের আমগোড়িয়ার বাড়িতে প্রথম দেবীমূর্তি নিয়ে এসেছিলেন রাধাবল্লভ রায়। তাঁর স্ত্রী সিন্ধুবালাদেবীর ইচ্ছেতেই ১৩১৯ বঙ্গাব্দ থেকে রায়বাড়িতে শুরু হয় দুর্গাপুজো। এখন ফি বছর মন্দির রং করা, ফুলের জোগাড়, সব্জি কাটার মতো নানা দরকারে সাহায্য করেন নিমাই ও নিতাই মণ্ডল। তাঁদের বাড়ির লোকজনও।
শুধু কী তাই? পুরোহিতদের সেবা থেকে শুরু করে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে উদ্ধারণপুর থেকে ভাগীরথীর জল আনা। কলা-বউয়ের পাল্কি ধুয়ে মুছে তকতকে করা। আরও কত কাজ! অথচ দেবীর প্রাণপ্রতিষ্ঠা হলেই টানা হয়ে যায় অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখা। তখন আর মন্দিরের কাছে যাওয়া ওঁদের ‘নিষেধ’। |
রায় পরিবারের সদস্য শিশিরবাবু অবশ্য মেনে নেন, “নিমাইবাবু-নিতাইবাবুরা ছাড়া বাড়িতে পুজো করা অসম্ভব ছিল।” কিন্তু শুধু সেই মণ্ডলেরাই নন। ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কোনও সম্প্রদায়ের মানুষের দেবীর কাছে যাওয়ার অধিকার নেই রায়বাড়িতে। শতবর্ষে পা দিলেও এখনও সেই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। নিতাইবাবুদের আক্ষেপ, “দেবী আমাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেন। অথচ তিনি মন্দিরে আসার পরে আমরা দূরে সরে যাই। পুজোর সময়ে এখানে কাজ করি আর অঞ্জলি দিতে যেতে হয় অন্য জায়গায়।”
নিয়মের নিগড় এমনই যে কাটোয়া হাসপাতালের প্রাক্তন সুপার টি কে দাস কিংবা চিকিৎসক প্রীতি ঘোষ কেউই ওই বাড়িতে দেবীর কাছে যাওয়ার সুযোগ পাননি। বছর সাতেক আগে ভিন্ রাজ্য থেকে বাড়ির এক জনের বন্ধু এসেছিলেন। ব্রাহ্মণ নন, তাই তাঁকেও অঞ্জলি দিতে দেওয়া হয়নি। রায় বাড়ির কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিদেশে কর্মরত। অনেকে শিক্ষাজগতের সঙ্গেও যুক্ত। সকলেই এই প্রথা মানতে পারেন, তা নয়। নতুন প্রজন্মের সৈকত, শ্রাবণীদের বক্তব্য, “দেবীর কাছে সবাই সমান। সব সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো দিতে পারেন, বড়দের কাছে সেই দাবিই জানাব আমরা।”
কিন্তু সেই দাবি পূরণ হওয়া যে আদৌ সহজ নয়, তা পরিষ্কার হয়ে যায় এ বছর পুজোর দায়িত্বে থাকা জ্যোতিপ্রসাদ রায়ের কথায়। বর্তমানে উত্তর ২৪ পরগনার সোদপুরের বাসিন্দা জ্যোতিপ্রসাদবাবু নিজেকে ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ বলেই দাবি করেন। কিন্তু বাড়ির ‘নিয়ম’ ভাঙার প্রসঙ্গ উঠলেই তাঁর সাবধানী প্রশ্ন, “পারিবারিক রীতিনীতি ভাঙার দায় কে নেবে?”
জ্যোতিপ্রসাদবাবুর উদ্যোগেই এ বার মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। পুজোর শতবর্ষ উপলক্ষে গোটা গ্রামকে নিমন্ত্রণ করেছেন তাঁরা। দান করবেন একশো শীতবস্ত্রও। কিন্তু সবই হবে আঙিনার বাইরে। বধূ গীতারানি রায়, মিনতি রায়েদের মতে, “সবই তাঁর ইচ্ছা। তিনি চাইলে কবেই এই প্রথা ভেঙে যেত।”
যদি কখনও ‘তাঁর’ ইচ্ছা হয়, সেই আশাতেই আপাতত অপেক্ষা করে যেতে হবে ঘোষ, দাস, মণ্ডলদের। |