পুজো মানে তাঁদের কাছে সব ভুলে থাকার আনন্দ। তাঁরা বলতে এখানে পুরুলিয়ার হুড়া থানার রাকাবজঙ্গল ঘেরা কেশরগড় ও লাগোয়া গ্রামের মানুষদের কথা বলা হয়েছে।
কুলটাঁড়, কালীপুর, লায়াডি, ধাদকিটাঁড়, পিঁড়রলায়া প্রভৃতি আদিবাসী মানুষজনের জীবিকা বলতে দিনমজুরি বা জঙ্গল থেকে কাঠ-পাতা সংগ্রহ করা। তাই পুজো মানে ওই সব মানুষজনের কাছে নিত্যদিনের কাজ থেকে দূরে থাকার উৎসব। কেশরগড়স্কুলমোড়ে গিয়ে দেখা গেল, মাটির দুর্গামন্দির পরিষ্কার করছেন কিছু বাসিন্দা। মন্দিরের ভিতরে মূর্তি গড়ছেন শিল্পী। মেঘের গর্জন শুনলেই হারাধন বাউরি, ভীমসেন বাউরিরা মন্দিরের মাথায় ত্রিপল চাপিয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের কথায়, “ত্রিপল না চাপালে বৃষ্টিতে প্রতিমা ধুয়ে যাবে। কিছু দিন আগে টালির ছাউনি দেওয়া ছোট্ট মন্দির ছিল। সকলে মিলে মন্দির বড় করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই ছাউনি সরিয়ে পুরনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। তাই মাথার উপরে ছাদ নেই।” |
মন্দিরের মাথায় ছাদ নেই। ঝাঁ চকচকে আলোয় ভেসে যাওয়া মণ্ডপ নেই। তবুও আন্তরিকতার কাছে সব প্রতিবন্ধকতা হার মেনেছে। কেশরগড় সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির এ পুজোর শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। কেশরগড় মানেই ইতিহাসের গন্ধ। ১৮২৩ সালে এখানে পঞ্চকোট রাজবংশের গড় ছিল। তার ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। উদ্যোক্তারা জানালেন, বড়দের কাছে শুনেছেন পুজোয় তাঁরা ব্রাত্য ছিলেন। স্থানীয় কৃষ্ণানন্দ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক নরেন চক্রবর্তী বলেন, “এই যে ছোববড় জনপদগুলি জঙ্গলে ছড়িয়ে রয়েছে এই গ্রামগুলির বেশিরভাগ মানুষ আদিবাসী, হরিজন, সাঁওতাল সম্প্রদায়ের। ১৯৬৫ সালে তাঁরা এই অঞ্চলের পুজোয় সে ভাবে যোগ দিতে পারতেন না। তা ছাড়া, এলাকায় সে ভাবে পুজোও হত না।” তিনি জানান, এই বিদ্যাপীঠের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক তপেশানন্দ মহারাজ, স্থানীয় দয়াময় চক্রবর্তী ও বন দফতরের কয়েক জন কর্মীকে এ বিষয়ে নাড়া দেয়। তখন থেকেই তাঁরা পুজো শুরু করেন।
তবে যত দিন যাচ্ছে আদিবাসী-হরিজনদের পাশাপাশি অন্যদেরও নিজের পুজো হয়ে উঠছে।
কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে বাপি সিং সর্দার, গম্ভীর সিং সর্দার, অমিত চক্রবর্তীরা বলেন, “নবমীর দিনে মণ্ডপ প্রাঙ্গণে সকলে খিচুড়ি প্রসাদে যোগ দেবেন। এটাই আমাদের রীতি।” অন্য দিকে তখন চলছে আদিবাসী নৃত্যের মহড়া। বালিকা মুর্মু, সন্ধারানি কিস্কুদের কথায়, “পুজো মানে আমাদের কাছে নিজস্ব সংস্কৃতির অনুষ্ঠান। এটা আমাদের কাছে বড় আনন্দের। তাই পুজোয় নিজেদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে প্রস্তুতি দেওয়া হচ্ছে।” |