|
|
|
|
মর্গ্যানের ভুলের পাহাড়ে চাপা পড়ল ইস্টবেঙ্গল |
রূপায়ণ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
সালগাওকর-৩ (চিডি, ফ্রান্সিস, সুয়োকা)
ইস্টবেঙ্গল-১ (গাও-পেনাল্টি) |
কোচিতে কোচিং সেরে ত্রিসুর ফেরার পথে গাড়িতে তখন। টি কে চাত্তুণ্ণি খেলাটা দেখেননি। ফোনে স্কোর শুনে বিস্ফারিত, “আবার সালগাওকর! বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু আনন্দ হচ্ছে খুব। এক ঝটকায় চোদ্দো বছর পিছনে চলে গেলাম।”
গোয়ার ক্যালাঙ্গুটের বাড়িতে ব্রুনো কুটিনহো বসে টিভি দেখছিলেন। অপকট প্রশংসা মুখে, “আমাদের থেকে সালগাওকরের এই জয়টাই বেশি কৃতিত্ব। আমাদের টিমটা অনেক ভাল ছিল।”
চোদ্দো বছর আগের যুবভারতীতে সালগাওকরের ইস্টবেঙ্গল-বধের দুই রূপকথার নায়ক সত্যি এই স্কোর ভাবেননি।
চোদ্দো বছর পরের যুবভারতীতে ফিরি। ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার বহু পরেও অনেক দর্শক গ্যালারিতে তখনও বসে। তাঁদেরও ৩-১ অবিশ্বাস্য লাগছে চাত্তুণ্ণি-ব্রুনোর মতো।
আরও চোদ্দো বছর পরে, ২০২৫ সালে এই ফেড কাপ ফাইনালের ভিডিও দেখলে ট্রেভর মর্গ্যানের নিজেরও অবিশ্বাস্য মনে হবে।
একটা ম্যাচে একসঙ্গে কত ভুল করতে পারেন এক জন কোচ? |
|
প্রতিদ্বন্দ্বী কোচ মর্গ্যানকে উড়িয়ে সতীর্থরা ওড়ালেন করিমকেও। বৃহস্পতিবার। ছবি: উৎপল সরকার |
দুটো? বড় জোর তিনটে?
মনে করতে পারছি না, ভারতীয় ফুটবলে এক ম্যাচে এক বিদেশি কোচ গোটা সাতেক ভুল করেছেন। জন্মদিনের আগের দিন মর্গ্যানের পা থেকে মাথা যেন পুরোটাই ভুলের বিষবৃক্ষের শিকড়ে জড়িয়ে ছিল।
কত বলব? মেহতাব হোসেনকে চোট নিয়ে নামানো। আহত রাজু গায়কোয়াড়কে প্রথম দলে রাখা। টোলগেকে প্রথম থেকে না খেলানো। বিরতির পরে দল যখন প্রত্যাবর্তনের চেষ্টায়, তখন পেনকে তুলে নেওয়া। গাও (অ্যালান) এবং সিংহ (রবীন) অক্ষম দেখেও তাঁদের রেখে দেওয়া। লং বলের স্ট্র্যাটেজি না বদলানো। রাজুরা রক্ষণে কাঁপছেন দেখেও ডিফেন্সিভ স্ক্রিন তুলে দেওয়া।
ফাইনালটা শেষ হওয়ার সামান্য আগে শুধু করিম বেঞ্চারিফাকেই দেখছিলাম। সিংহের মতো হাঁটছিলেন বেঞ্চের সামনে। শেষ বাঁশি বাজতেই হাত তুলে শুয়ে পড়লেন। তাঁকে কাঁধে তুলে লোফালুফিতে ব্যস্ত পুরো দল। জন্মদিনের আগে মর্গ্যান যেন নিজেই করিমের হাতে তুলে দিলেন সিংহাসন।
ওয়ার্ম আপ করার সময়ই চূড়ান্ত বিস্ময় অপেক্ষা করছিল দুটো দলে। ইস্টবেঙ্গলে টোলগে নেই--গ্যালারিতে সবচেয়ে বড় ছবিটা যাঁর ঝুলছিল। সালগাওকরে নেই সুয়োকামেহতাব যাঁকে সবচেয়ে আতঙ্ক ধরছিলেন।
বিস্ময় ঠিক নয়, এর পরের অংশে কৌতূহল। মর্গ্যান কুঁচকির চোটে কাতর দু’জনকেই দলে রেখেছেন। মেহতাব এবং রাজু। বিদেশি কোচেরা এমনিতে একেবারে ফিট না হলে ফুটবলারদের দলে রাখেন না। “চল, ‘মা’ বলে ফাটিয়ে দিয়ে আসি” বলে পুরনো আমলের মতো মাংসের টুকরো, ভেষজের ব্যান্ডেজ পায়ে লাগিয়ে চোট পাওয়া ছাত্রদের নামিয়ে দেন না। মর্গ্যানের গায়ে কলকাতার কোচেদের হাওয়া লাগল নির্ঘাৎ। |
|
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
দুটো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ভুল। দু’মিনিটে মেহতাব যখন চোট পেয়ে বেরিয়ে গেলেন, তখন পুরো ইস্টবেঙ্গল বিস্ময়, শোক, অবিশ্বাসের শেষ সীমায়। মেহতাব তখনও বসেননি। মর্গ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সাইডলাইনের বাইরে। জুনিয়রের একটি নিরামিষ ফ্রি-কিক থেকে হেডে গোল করে দিলেন চিডি। ওপারা-রাজু কোথায় তখন? পুজোর বাজার করতে? চিডির গায়ে উদাস দর্শক হরমনজিৎ। সন্দীপ নন্দী এখন আউটিংয়ের সময় দ্বিধায় ভোগেন।
স্টেডিয়ামের বাইরে ম্যাচের এক ঘণ্টা আগে দেদার বিকোচ্ছিল হলুদ-লাল জার্সি। ভিআই পি বক্সে তখনই বাতাসে জোহানেসবার্গ, কেপটাউনের গন্ধ নিয়ে হাজির ভুভুজেলা। হাজার ষাটেক মুখ। মাঠে আগুন জ্বালানোর আদর্শ পরিবেশ। ইস্টবেঙ্গল ১-১ করার বদলে ০-২ করে ফেলল রক্ষণের ভুলে। করিমের কসমোপলিটান টিমের একমাত্র গোয়ান মুখ ফ্রান্সিস ডি’সিলভা অনেকটা দৌড়ে গোল করে গেলেন। চার ডিফেন্ডার তখনও ট্রাফিকে দাঁড়ানো চারটে স্থবির মিনিবাস। সন্দীপ সেই গ্রিপিংয়ের ভুলে জর্জরিত।
আসলে সন্দীপ থেকে গাওইস্টবেঙ্গলের এগারো মনে হল মেহতাব বেরিয়ে যাওয়ার শকথেরাপিতে বিধ্বস্ত। আলো আনতেন কে? ওপারা গত বারের দাপটে নেই। গাও, পেন বা সঞ্জুর উপর দায়িত্ব ছিল গতির আলো আনার। ২৫ মিনিটে আলোটা সামান্য জ্বালাল পেনাল্টি। পেনকে লুসিয়ানো বক্সে ট্যাকল করার সময় বলটা বেরিয়ে যাচ্ছিল। তবে পেনের জামাটা ধরে রেখেছিলেন সালগাওকরের সেরা ডিফেন্ডার। পায়ে একটা পা লেগে যায়। রেফারি পেনাল্টি দিতেও পারতেন, না দিলেও পারতেন। বিরতিতে প্রাক্তন রেফারি, মোহন-ইস্টের প্রাক্তন তারকাদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেল, দুটো ভাগ। অবাক করে ইস্টবেঙ্গলের এক নামী মুখ বললেন, “না দিলেও চলত।” মোহনবাগানের এক প্রাক্তনের রায়, “পেনাল্টিতে কিছু বলার নেই।” |
|
শেষরক্ষার চেষ্টা। পেনকে তুলে নামানো হল টোলগেকে।-নিজস্ব চিত্র |
হাতে দূরবিন ছিল না। বোঝা যায়নি, মর্গ্যান মাঝমাঠ থেকে পেনকে তুলে নিতে করিমের চোখ চকচকে হয়ে উঠেছিল কি না। সঙ্গে সঙ্গে দাবার চাল দেওয়ার মতো সালগাওকর কোচ নামান তাঁর সেরা গতিময় অস্ত্র সুয়োকাকে। পেনাল্টির অক্সিজেন পেয়ে এতক্ষণ ইস্টবেঙ্গল খেলছিল, রবীনের ভুলে দুটো সিটার হারিয়েছে। ছবিটা উল্টে গেল। ভাসুম, সঞ্জু, হরমনজিৎ যেন মাঝমাঠে অদৃশ্য সে সময়। চুপিসাড়ে মাঝমাঠ লুণ্ঠন করে নিলেন জাপানি সুয়োকা।
ওই সময় আবার মর্গ্যান-হাউসে এক ছবি। করিমের চার বিদেশিই যেখানে হিট, মর্গ্যানের সবাই ফ্লপ। ওপারারা চার ডিফেন্ডার দাঁড়িয়ে। গোলকিপার সন্দীপের হাত থেকে বল ছিটকে যাচ্ছে। ৩-১ সুয়োকারই। করিমের চাল ছিল, ক্লান্ত বিপক্ষকে সুয়োকার গতিতে ধস নামানো। একশোয় একশো।
মর্গ্যান এই ফাইনালের আগে ৬৭টি ম্যাচ খেলে জিতেছেন ৪২টি। যত দিন সাহেব পরীক্ষানিরীক্ষা না করেছেন, ততদিন বেশ চলছিল। এ বার অমল দত্ত স্টাইলে বেশি পরীক্ষা করতে গিয়েই ডুবলেন। রোভার্স, ডুরান্ড, স্ট্যাফোর্ড, সিজার্স, নাগজি, সিকিমসব টুর্নামেন্টে খেলতে যায় না বলে ট্রফি জয় এখন অনেক কম বড় ক্লাবের। ইস্টবেঙ্গলকে দেখুনগত ছয় মরসুমে মাত্র পাঁচটি বড় ট্রফি। দু’বার কোনও ট্রফি নেই। কোচ এত অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখালে এ বার কী হবে? |
|
যন্ত্রণা। গোল ফস্কে রবিন। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
জেব্রার গায়ের দাগে যেমন অঙ্ক ও সৌন্দর্য দুটোই মিশে থাকে, সালগাওকরের ফুটবলে লেখা ছিল ও রকম। দৌড় যেখানে দরকার, সেখানে দৌড়। পাস যেখানে দরকার, সেখানে পাস। নয় জনে নেমে আসা ব্রাজিলিয়ান স্টপার লুসিয়ানোর নেতৃত্বে। ফের চিডিকে কেন্দ্র করে প্রতিআক্রমণ। নিন্দুকদের রক্তচক্ষু উড়িয়ে দিল মোহনবাগানের সব বাতিল মুখসুয়োকা, টোম্বা, ইসফাক, রোকাস, বিশ্বজিৎ, রাহুল! ইস্টবেঙ্গলকে ঘরের মাঠে লজ্জা দিতে তো এঁরাই যথেষ্ট। এঁরা পারেন তা হলে!
মরক্কোর করিম বেঞ্চারিফা আসলে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান দুটো দলকেই তীব্র লজ্জায় ফেলে গেলেন। আই লিগের পরে আবার। আর কোথায়, না ফেড কাপেগত পাঁচ বছর ধরে যা ছিল কলকাতার সম্পত্তি। স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় আনন্দে চিডি তাঁর বুট ছুড়ে ফেলেছিলেন গ্যালারিতে। সেই বুট উপহার না নিয়ে হতাশ লাল হলুদ সমর্থকরা ছুড়ে দিলেন মাঠেই।
এত লজ্জার তিন গোল! দুটো বুট নিয়ে কী হবে?
ইস্টবেঙ্গল: সন্দীপ, সৌমিক, ওপারা, রাজু, নওবা (পাইতে), ভাসুম, মেহতাব (সঞ্জু), হরমনজিৎ, পেন (টোলগে), গাও, রবিন। |
গোল ১: ৪মিনিট। জুনিয়রের ফ্রিকিকে চিডির হেড। তখন তাঁর পাশে শুধু হরমোনজোৎ। লাল-হলুদ রক্ষণ অপ্রস্তুত। গোল ২: ১৯ মিনিট। ফ্রান্সিসের শট সন্দীপ নন্দীর হাত থেকে ছিটকে বেরলো। ক্লিয়ার করতে ব্যর্থ রক্ষণ। ফিরতি শটে গোল। গোল ৩: ৬৭ মিনিট। চিডির ক্রস সন্দীপের হাত থেকে ছিটকে সুয়োকার পায়ে। গড়ানো শটেই গোল। |
|
|
|
|
|
|