ভবানীপুর ও বসিরহাট (উত্তর) বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়লাভে অপ্রত্যাশিত কিছু নাই। ভবানীপুরে তাঁহার দলের বিধায়কের ছাড়িয়া দেওয়া আসনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বড় ব্যবধানেই জিতিবেন, তাহা লইয়া কোনও পর্যায়েই কাহারও সংশয় ছিল না। তুলনায় বসিরহাট উত্তর আসনটি সি পি আই এমের কাছ হইতে ছিনাইয়া লওয়ার কৃতিত্ব বেশি, যদিও সেখানেও বাম প্রার্থীর জয়ের ব্যবধান এতই কম ছিল যে, রাজ্যব্যাপী বাম-বিরোধী হাওয়ার অভিঘাত সহ্য করার ক্ষমতা সি পি আই এমের ছিল না। বাম নেতৃত্ব এ জন্যই সম্ভবত দুই আসনের কোথাওই প্রচারে বা সংগঠনে সর্বস্ব বাজি ধরে নাই, বরং কতকটা দায়সারা ভাবেই ভোটের আগেই ভবিতব্যকে শিরোধার্য করিয়া লইয়াছিল। এই জয় দেখাইয়া দিয়াছে, রাজ্য রাজনীতিতে বাম-বিরোধী হাওয়ার বেগ এখনও যথেষ্ট এবং সেই হাওয়া যে তৃণমূল কংগ্রেসের পালেই খেলিতেছে, তাহাও নিশ্চিত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইহা জানিয়া আশ্বস্ত হইতে পারেন যে, এখনও বেশ কিছু কাল তাঁহার ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকারের প্রতি রাজ্যবাসীর আস্থা অবিচল থাকিবে।
আর এখানেই মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা জনসাধারণের নজরবন্দি থাকিবে। বেশি ভোট পাওয়া মানে বেশি জনপ্রিয়তার ঢেউয়ে সওয়ার হওয়া। ক্ষমতার সহিত যুক্ত এই জনপ্রিয়তা অনেক সময়েই যথার্থ জনকল্যাণের বাস্তব দাবিকে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দেয়, যাহার ফলে জননেতারা তাঁহাদের নির্বাচনী সাফল্য ধরিয়া রাখার তাড়নায় জনমনোরঞ্জনের দিকে ঝুঁকিয়া পড়েন। ট্রেনের ভাড়া না-বাড়াইবার সিদ্ধান্ত এমনই জনতোষণী কার্য। জল-কর না-বসানো, রাজপথ হকারমুক্ত না করা বা সরকারি পরিবহণে কর্মী-সঙ্কোচন না-করিয়া বছর-বছর কর্মহীন কর্মীদের বেতন-ভাতা গনিয়া যাওয়ার লোকসান পুরাইতে ভর্তুকি দেওয়াও একই ধরনের কর্মসূচি। এই ধরনের কর্মসূচি বা সিদ্ধান্তের ফলে কতিপয় ভোটারের সমর্থন হারাইবার ভয়ে বৃহত্তর মঙ্গলচিন্তা অন্তরালে চলিয়া যায়। সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী নেতার নামে জয়ধ্বনি দেয় বটে, তবে সেই সম্মিলিত ধ্বনির আড়ালে চাপা পড়িয়া যায় রাজ্যকে স্বনির্ভর করার প্রকল্প, যানবাহনে গতি-সঞ্চারের প্রয়োজন। কাজের দিনের কলিকাতাকে মিছিল-মিটিংয়ের কর্মহীনতার অচলাবস্থায় রূপান্তরিত করার বিরুদ্ধে নাগরিকদের ক্ষোভ যেমন চাপা পড়ে ‘জনসাধারণের আন্দোলন করার গণতান্ত্রিক অধিকারের’ আস্ফালনে। এই সকল ক্ষেত্রেই কঠোর, আপাত-অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি।
জনাদেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সুশাসনের সেই দায়ই দিয়াছে। ক্রমশ নীচে নামিতে থাকা ভূগর্ভস্থ জলস্তর কৃষিতে বিপর্যয় ও আর্সেনিকের দূষণ ঘনাইয়া তুলিয়াছে। এখন সব নলকূপ বন্ধ করিয়া চাষিদের প্রাথমিক ক্ষোভের সম্মুখীন হওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক সাহস লাগে, রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করিয়া জৈব পদ্ধতিতে চাষ চালু করিতে যে কল্পনাশক্তি লাগে, কৃষিতে সমবায় ব্যবস্থা প্রবর্তন করিয়া উৎপাদন ও কৃষিপণ্যের গুণমান বৃদ্ধির অভিযানে চাষিদের শামিল করিতে যে প্রেরণা লাগে, তাহা জনতোষণের তাগিদ হইতে আসে না। একই ভাবে শিল্পায়নের জন্য যে কৃষিজমির প্রয়োজন, তাহার অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ হইলেও নূতন কলকারখানা, আবাসন, নগরায়ণ প্রকল্প কিছুই গড়িয়া উঠিবে না, কোনও বিনিয়োগকারীই লগ্নি করিতে আসিবেন না। জমি হারানোর ভয় হইতে মানুষ হয়তো তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দিয়াছে। কিন্তু রাজ্যের অর্থনৈতিক উজ্জীবন ঘটাইতে তো লগ্নিকারীদেরও ভয় ভাঙানো দরকার! সর্ব ক্ষেত্রেই কিছু পাইতে গেলে কিছু ছাড়িতে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি তাঁহার ভোটদাতাদের একাংশের বিরূপ হওয়ার ঝুঁকি লইয়া রাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে কড়া প্রশাসনিক ও নীতিগত সিদ্ধান্ত লন, তবে আখেরে কিন্তু তাঁহার দল ও সরকারের লাভই হইবে। বর্ধিত জনাদেশ তাঁহার অগ্রগতির পথে প্রেরণা হইয়া উঠিবে। |