সনিয়া গাঁধীর হস্তক্ষেপে আজ টু-জি বিতর্কে আপাতত যুদ্ধবিরতি হল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অন্দরমহলে।
টানা ন’দিন টানাপোড়েন ও ইগোর লড়াইয়ের পর অবশেষে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় যেমন জানিয়ে দিলেন, স্পেকট্রাম বণ্টন নিয়ে বিতর্কিত নোটে যে উপসংহার (কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম সম্পর্কে) টানা হয়েছে, তা তাঁর মত নয়। তেমনই প্রণববাবুর পাশে দাঁড়িয়ে চিদম্বরমও জানিয়ে দিলেন, এই বিবৃতিতে তিনি খুশি। বিষয়টি এখন ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’।
কিন্তু তাই কি? বরং কংগ্রেস সূত্রের মতে গৃহশান্তি ফিরলেও, বিতর্কিত নোটটিকে কেন্দ্র করে আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের চ্যালেঞ্জ ঝুলেই রইল সরকারের সামনে।
ইউপিএ-র শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আজ যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেই কথাটা প্রথম দিন থেকেই সরকারের অন্দরে বলে আসছেন তিনি। নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ও পরে দেশে ফিরে সনিয়াকেও একই কথা জানিয়েছিলেন প্রণববাবু। এমনকী, গত পরশু সকালে প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো তাঁর চিঠিতেও এই কথাটি স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল।
কিন্তু তার পরেও চিদম্বরম গোঁ ধরে ছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি ছিল, প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে প্রণববাবুকে জানাতে হবে, তিনি (চিদম্বরম) চাইলে স্পেকট্রাম বণ্টন নিয়ে আর্থিক ক্ষতি ঠেকাতে পারতেন বলে নোটে যে মন্তব্য করা হয়েছে, সেটা তাঁর মত নয়। গত কাল রাতে চিদম্বরমকে ফোন করেন প্রণববাবু। চিদম্বরম তাঁকে বলেন, আপনি বিবৃতি না দিলে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ হবে না। আবার প্রণববাবুও প্রধানমন্ত্রীকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তিনি এক তরফা কোনও বিবৃতি দেবেন না। নোটের বিতর্কিত অংশটি যখন তাঁর মত নয়, তখন আগ বাড়িয়ে তিনিই বা কেন কৈফিয়ত দেবেন! তবে সরকারের সঙ্কট কাটাতে চিদম্বরমের সঙ্গে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে তাঁর আপত্তি নেই।
চলতি বিতর্ক সরকার ও কংগ্রেস সম্পর্কে প্রবল নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে বুঝতে পেরে আজ সকাল থেকে রাশ নিজের হাতে নিয়ে নেন কংগ্রেস সভানেত্রী। প্রথমে সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল নর্থ ব্লকে গিয়ে প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি, আহমেদ পটেল ও প্রণববাবু ১০ জনপথে গিয়ে সনিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। কংগ্রেস শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রণববাবুকে সনিয়া বলেন, সরকারের সঙ্কট নিরসনে আপনি বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এ বারও আপনিই বিষয়টি সামলান।
১০ জনপথে ওই বৈঠকের পর বিকেলে ৭ রেস কোর্স রোডে প্রধানমন্ত্রী, প্রণববাবু ও চিদম্বরম বৈঠকে বসেন। বিবৃতির বয়ান স্থির হয়। তার পর সন্ধ্যায় নর্থ ব্লকের সামনে সাংবাদিকদের প্রণববাবু বলেন, “স্পেকট্রাম বিতর্ক নিয়ে এ বছর জানুয়ারি মাসের গোড়ায় সংবাদমাধ্যমে বেশ কিছু খবর প্রকাশ হয়। তখন স্থির হয় সরকারের তরফে এক সুরে কথা বলার জন্য একটি নোট প্রস্তুত করা হবে। বিভিন্ন মন্ত্রকের আমলাদের নিয়ে গঠিত গোষ্ঠী এর পর একটি নোট প্রস্তুত করে, যা ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে পাঠানো হয়।” তাঁর কথায়, “তথ্যগত ঘটনা ছাড়াও ওই নোটে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু উপসংহার টানা হয়েছে। যা আমার মত নয়।” একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ২০০৩ সালে এনডিএ জমানায় যে টেলিকম নীতি নেওয়া হয়েছিল, ২০০৭-০৮ পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল।
প্রণববাবুর এই মন্তব্যের পর চিদম্বরম শিবিরের তরফে দাবি করা হয়, শেষ পর্যন্ত কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরই জয় হল। কেন না, প্রণববাবুকে দিয়ে বিবৃতি দিইয়ে ছাড়লেন তিনি। এই বিবৃতি প্রণববাবু আগে দিয়ে দিলে এত দিন ধরে সঙ্কট জিইয়ে থাকত না। |
তবে প্রণব ঘনিষ্ঠদের মতে, বিবৃতি দিয়ে অর্থমন্ত্রী কিন্তু এটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তিনি চিদম্বরমকে বিপাকে ফেলতে চাইছিলেন বলে যে রাজনৈতিক রটনা চলছিল, তা ভ্রান্ত। তা ছাড়া নোটটি বিভিন্ন মন্ত্রকের মিলিত বলেই তিনি ক্ষান্ত
থাকেননি, যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের সময় কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ ও টেলিকম মন্ত্রী কপিল সিব্বলকে হাজির রেখে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নোট প্রস্তুতির উদ্যোগ ছিল সামগ্রিক ভাবে সরকারের। প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হচ্ছে, ওই রকম একটি অতি গোপন ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার কী করে প্রকাশ হল, সেটা নিয়েও তিনি প্রথম দিন থেকে সরকারের মধ্যে প্রশ্ন তুলছেন। বলেছেন, তা হলে মন্ত্রিসভার গোপনীয়তা রক্ষা আর হল কোথায়! এমনকী নোটটিকে কেন্দ্র করে তাঁর ভাবমূর্তি মলিন করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করে, নিউ ইয়র্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রণববাবু বলেন, মন্ত্রিপদে টিকে থাকাটাই আমার কাছে পরম বিষয় নয়। বরং আপনি আমাকে অব্যহতি দিন। তবে মনমোহন ও সনিয়া দু’জনেই তাঁকে নিরস্ত করেন এবং সঙ্কট মোচনের দায়িত্ব তাঁকেই দেন।
কিন্তু এর পরেও সঙ্কট পুরোপুরি কাটল কিনা, সে প্রশ্ন থাকছেই। স্পেকট্রাম বিতর্কে চিদম্বরমের বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত চেয়ে সুব্রহ্মণ্যম স্বামী সুপ্রিম কোর্টে যে মামলা করেছেন, আজও তার শুনানি ছিল। তবে আদালত এখনও কোনও রায় দেয়নি। নবরাত্রির জন্য আদালত ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি থাকবে। তার পর ফের শুনানি হবে। ফলে আইনি লড়াই থেকেই গেল। সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয় গেল যে, বিতর্কিত নোটের উপসংহার প্রণববাবুর মত না হতে পারে, কিন্তু সরকারের তরফেই এটা বলা হয়েছে যে, চিদম্বরম চাইলে স্পেকট্রাম নিয়ে ক্ষতি এড়াতে পারতেন।
ফলে চিদম্বরম বিষয়টি ‘ক্লোজড চ্যাপ্টার’ বললেও বিজেপি মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ আজ বলেন, “প্রণববাবু বলেছেন ঠিকই যে, বিতর্কিত মন্তব্যটি তাঁর মত নয়, কিন্তু একই সঙ্গে এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন, বিভিন্ন মন্ত্রক মিলে ব্যাকগ্রাউন্ড পেপারটি তৈরি করেছে। যার অর্থ হল, চিদম্বরমের অপরাধ কিন্তু লঘু হচ্ছে না। টু-জি কাণ্ডে চিদম্বরম পুরোমাত্রায় দোষী। তাঁর অপসারণের দাবি থেকেও বিজেপি কোনও ভাবেই সরে আসছে না।” |