মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুরের ভালুকাবাজার বাসষ্ট্যান্ডে চারদিক খোলা জীর্ণ একচালায় বসে সারা বছর জুতো সেলাই করেন অর্জুন রবিদাস। তাঁরই প্রতিবেশী সুনীল রবিদাস বছরভর দিল্লিতে রিকশা চালান। রতুয়ার কাহালার কার্তিক দাস, দেবীপুরের গৌর দাসরা দিল্লি ও মুম্বইয়ে শ্রমিকের কাজ করেন। অথচ চাঁচল মহকুমার বিভিন্ন এলাকার এই বাসিন্দাদের একসময় পেশা ছিল ঢাক বাজান। সেই পেশায় আর একবেলাও সংসারের সবার খাবার জোটে না। সিডি, ক্যাসেটের দাপটের কাছে হার মেনে কেউ ঘর ছেড়ে ভিনরাজ্যে গিয়ে আবার অনেকেই ভিন্ন পেশা আঁকড়ে বাঁচার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু বাড়ির পাশে ফুলহার নদীর চড়ায় কাশফুল ফুটতেই মনটা উদাস হয়ে যায় অর্জুন রবিদাসের। জুতো সারাইয়ের যন্ত্রপাতি সরিয়ে ঘরের এককোণে ঝোলানো ঢাকটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেন। আর দিল্লি, মুম্বইয়ের রাস্তায় রিকশা চালানোর সময় আকাশে পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘ ভাসতে দেখেই সুনীল রবিদাস, গৌর দাসদের মনটাও কেমন যেন আনচান করে ওঠে। তারপর নেশাতুরের মতো ঘরে ফিরে ঘরের কোণে অযত্নে ঝোলানো ঢাকটাকে নিয়ে শুরু হয় মেরামতির প্রস্তুতি। এর মধ্যে ভিনরাজ্য থেকে ঘরে ফিরেও এসেছেন সুনীল রবিদাস, গৌর দাসরা। বংশপরম্পরায় তৈরি হওয়া ভালোবাসার টানে পরম মমতায় ঢাকটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছেন। ঢ্যাং কুড়-কুড় বোল তুলে দেখে নিচ্ছেন সব ঠিকঠাক আছে কি না। আর তাই ঢাকিদের পাড়ায় ঢুঁ মারলে এখন শোনা যাবে ওই মাদকতা মেশানো বোল। এত সবের পরেও কাজ জুটবে কিনা তার কোনও নিশ্চয়তা নেই ওই ঢাকিদের। সিডি, ক্যাসেটের দাপটের কাছে হার মেনে ঢাকের বোলের ছন্দ তো কবেই হারিয়ে গিয়েছে। তবু প্রস্তুত হয়ে থাকেন ওরা। প্রস্তুত হয়ে থাকেন স্রেফ নেশার টানেই। কেননা বছর ভরের যন্ত্রণা কয়েকটা দিনের জন্য হলেও ভুলে থাকেন ওঁরা। তাই উপার্জনের অঙ্কে লাভক্ষতির হিসেব না করে নেশা আর ভালোবাসার টানে পুজোর কয়েকদিন আগে থেকেই ঢাক কাঁধে নিয়ে শহরের দিকে পাড়ি দেন অনেকেই। অনেক সময় সামান্য পারিশ্রমিকেও ঢাক বাজাতে রাজি হয়ে যান। সাবেকি ঢাকের কদর কমে যাওয়ার পর ভিন্ন পেশা আঁকড়ে ধরা প্রায় অধিকাংশ ঢাকির জীবনচরিত কমবেশি এখন এটাই। চাঁচলের সিহিপুর, কলিগ্রাম, রতুয়ার দেবীপুর, কাহালা বা হরিশ্চন্দ্রপুরের ভালুকাবাজার এলাকার কয়েকশো ঢাকি পরিবারের ঘরে ঘরেই অভাবের ছবি। সেই অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিতে ভরসা ভিন রাজ্য কিংবা জুতো সেলাই থেকে রিকশা চালান। বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পুজা এখন আর ওদের কাছে বাড়তি রোজগারের সময় নয়। শুধুই রয়েছে বাপ ঠাকুদার আমল থেকে ঢাকের প্রতি তৈরি হওয়া ভালোবাসা আর নেশার টান। আর নেশার টানেই শরতের নীল আকাশ, কাশফুল ফোটার মাসে এলোমেলো ওদের জীবন! অর্জুন রবিদাস বলেন, “ঢাক বাজিয়ে এখন আর সংসার চলে না। তাই সারা বছর জুতো সেলাই করি। রোজগারের নিশ্চয়তা নেই জেনেও পুজোর কটা দিন প্রস্তুত হয়ে থাকি। তখন অন্য কাজে আর মন বসে না।” গৌর দাসও বলেন, “সেই ছোটবেলায় বাবার সাথে কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে সঙ্গ দিতাম। ঢাক-কাঁসরের শব্দে সবাই নেচে উঠত। কাশফুল দেখলে ওই ছবিটাই মনের গভীরে ভেসে ওঠে।” |