দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আফগানিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বুরহানুদ্দিন রব্বানির হত্যাকাণ্ডের পরে সম্ভবত অনেকটাই বদলাবে। রব্বানি তো আসলে কেবল এক জন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিই ছিলেন না। ইদানীং কালে দেশের শান্তি প্রক্রিয়ায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মধ্যস্থতাকারী।
১৯৯২-তে তালিবান বাহিনীর হাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান নাজিবুল্লার মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে রব্বানি যে পরের চার বছর দেশের কর্ণধার হতে পেরেছিলেন, তার পিছনে ছিল কুশলী চাল। এই কারণে জাতিগত পরিচয়ে তাজিক হয়েও দেশের বৃহত্তম এবং প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী পাখতুনদের বাগে আনতে তত বেগ পেতে হয়নি। পাক-ঘনিষ্ঠ গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার-এর বিরোধী বলে পরিচিত নর্দার্ন অ্যালায়ান্স-এর নেতা আহমদ শাহ মাসুদকে কাছে টেনে রব্বানি মোক্ষম চাল দিয়েছিলেন। কিন্তু এ বার আর শেষ রক্ষা হল না।
|
গোপন মার্কিন হানায় পাক ভূখণ্ডে অ্যাবটাবাদ শহরে ওসামা বিন লাদেন-এর মৃত্যুর পর থেকেই এই অঞ্চলের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। পাক-ভূখণ্ডে ক্রমাগত মার্কিন ড্রোন আক্রমণ নিয়ে আমেরিকার প্রতি বিদ্বেষ বাড়ছিল। কিন্তু ওসামা নিধনে যে ভাবে পাক সরকার, বিশেষ করে পাক সেনাবাহিনী তথা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স-এর (আই এস আই) প্রভাবশালী অংশকে অন্ধকারে রেখে ওয়াশিংটন সেনা অভিযান চালায়, তার প্রেক্ষিতে এই বিরূপতা তীব্র হয়। কিন্তু তার পরেও মূলত অর্থনৈতিক ও অংশত সামরিক স্বার্থে ইসলামাবাদ সরকারি ভাবে অনেকটাই নীরব থাকতে বাধ্য হয়েছে। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাইয়ের সহোদর আহমদ ওয়ালি কারজাই জুলাই মাসে আততায়ীর আক্রমণে প্রাণ হারান। অগস্টে রাজধানী কাবুলের মার্কিন দূতাবাসে জঙ্গি হানায় বহু মানুষ হতাহত হন। এই সবের পিছনেই পাক সাহায্যপুষ্ট হক্কানি গোষ্ঠী বা জঙ্গি নেটওয়ার্কের হাত ছিল বলে ওয়াশিংটন ও কাবুলের ধারণা। জালালুদ্দিন হক্কানি প্রতিষ্ঠিত ও বর্তমানে তাঁর ভাই সিরাজুদ্দিন পরিচালিত এই জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান ঘাঁটি পাকিস্তানের উত্তর ওয়াজিরিস্তান এলাকায়, এ অভিযোগ বহু দিনের। |
এ সত্ত্বেও শান্তি আলোচনা চলছিল। তালিবানদের সঙ্গে কাবুল সরকারের কথা চলুক, চাইছিল আমেরিকাও। ভারতও এতে উপকৃত হবে বলে আশায় ছিল। এই আলোচনায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন রব্বানি। কারজাই-ভ্রাতার মতো তিনি চটজলদি বোঝাপড়া গড়ে তোলায় তত দক্ষ ছিলেন না বটে, কিন্তু আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা তাঁকে শান্তি আলোচনায় অপরিহার্য করে তুলেছিল। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটো বাহিনী প্রত্যাহারের আগে তাজিক বংশোদ্ভূত হিসেবে তাঁর দৌত্য কতটা সময়োচিত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও তিনি সেই প্রশ্নের তোয়াক্কা করেননি কখনওই। তাই তাঁর এই অসময়ে প্রস্থান পাক-আফগান, বিশেষ করে পাক-মার্কিন সম্পর্কে ছায়া ফেলবেই। হক্কানি নেট ওয়ার্ককে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যেই ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদের মধ্যে শুরু হয়েছে চাপানউতোর।
|
আমেরিকার সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল মাইক ম্যুলেন সরাসরি আঙুল তুলেছেন পাকিস্তানের দিকে। মার্কিন সরকার আকারে-ইঙ্গিতে এবং সে-দেশের সংবাদমাধ্যম অনেকটাই প্রকাশ্যে এত দিন ইসলামাবাদকে নানা ঘটনায় দায়ী করলেও এত পদস্থ মার্কিন কর্তার এমন পাক-সমালোচনা কার্যত নজিরবিহীন। ৯/১১-র প্রেক্ষিতেই নয়, ঠান্ডা লড়াইয়ের আমল থেকেই পাক-মার্কিন সৌহার্দ্য সুবিদিত। পাকিস্তানের আফগান-সংলগ্নতা ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে আমেরিকার কাছে সে-দেশের গুরুত্ব অটুট রেখেছিল। সেই বোঝাপড়া কি টিকবে?
ভূ-রাজনীতির দিক থেকে দেখলে এমন সম্ভাবনা থাকছেই। অথচ, অন্য কতকগুলি প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, দশ বছর আগে ৯/১১-র পরে বুশ প্রশাসন যে আফগানিস্তান অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয়, তার লক্ষ্য পূরণ আজও ওয়াশিংটনের নাগালের বাইরে। প্রেসিডেন্ট ওবামা সে দেশ থেকে সেনা ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বটে, কিন্তু আফগান শান্তি প্রক্রিয়া এই ভাবে বিঘ্নিত হলে এবং তার পরিণামে মার্কিন-বিদ্বেষের মাত্রা আরও বাড়লে অচিরে সেনা সরানো সত্যিই সম্ভব হবে কি? ইরাক থেকে সম্পূর্ণ সেনা অপসারণ কঠিন। আফগানিস্তান (এখন সেখানে লক্ষাধিক সৈন্য) থেকে আরও কঠিন। এই বছরেই এখনও পর্যন্ত আফগানিস্তানে প্রায় সাড়ে চারশো সৈন্যের মৃত্যু ওয়াশিংটনের ওপর চাপ বাড়িয়েছে। দ্বিতীয়ত, বছর তিনেক আগে যে আর্থিক মন্দা আমেরিকাকে গ্রাস করতে শুরু করেছিল, তা থেকে এখনও মুক্তি মেলেনি। সুরাহা হয়নি বেকার সমস্যারও। এমতাবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট আফগান--বোঝা আরও কিছু দিন সামলাতে চাইবেন কি?
তৃতীয়ত, মধ্য প্রাচ্যে ‘আরব বসন্ত’ গোড়ায় ওয়াশিংটনকে উৎসাহিত করলেও যে সব দেশে স্বৈরতন্ত্রী শাসককে হটানো হয়েছে, সে সব দেশের ঘটনাপ্রবাহ এবং প্যালেস্তাইন সম্পর্কে তাদের অবস্থান নিয়ে মার্কিন কর্তারা অস্বস্তিতে। ইজরায়েলের সঙ্গে এই দেশগুলির পরিবর্তনশীল সমীকরণ, এলাকার তেলকেন্দ্রিক আর্থ-রাজনীতি এবং তার ওপরে আরব দেশগুলিতে কট্টরপন্থী ইসলামিদের উত্থানের পরিস্থিতি আমেরিকার উদ্বেগ বাড়িয়েছে। দৃশ্যতই চাপে থাকা মার্কিন কর্তারা এই প্রেক্ষিতে ইসলামাবাদকে হারাতে চাইবেন কি?
এই প্রেক্ষাপটে অ্যাডমিরাল ম্যুলেনের অভিযোগ পাকিস্তান- আমেরিকার মধ্যে একটা বিচ্ছেদের সম্ভাবনা জাগিয়েছে, ঠিকই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিচ্ছেদে লাভ চিনের। তা আমেরিকারও অজানা নয়। তাই, এই অঞ্চলের রাজনীতির প্রকৃতি বদলালেও এই বিচ্ছেদ সম্ভবত অনিবার্য নয়। সুতরাং নয়াদিল্লিকেও গোটা পরিস্থিতির ওপরে নজর রাখতে হবে।
|