প্রবন্ধ ১...
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেই প্রশাসন গতিশীল হয় না
কে বলে ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হয় না? পশ্চিমবঙ্গে অন্তত চোখের সামনে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছি। কবি শঙ্খ ঘোষের সাম্প্রতিক এক কবিতার শেষ লাইন হল ‘নিজেরই জয়ের কাছে পরাভূত হয়ো না কখনো।’ ২০০৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনের পর বামফ্রন্টের বিপুল জয়ের কাছে বুদ্ধবাবুদের পরাজিত হতে দেখেছি। আর ২০১১ সালের নির্বাচনের পর এখন বিপুল জয়ের কাছে মমতাদেবীদের পরাজয়ের চেহারা ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। নবীন সরকারের মাত্র মাস চারেকের অভিজ্ঞতায় এই কঠিন উচ্চারণ শোভন নয়, কাম্যও নয়। কিন্তু নিরুপায় আমি স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজেই তাঁর সরকারের ৯০ দিনের কাজের এক ফিরিস্তি জনসাধারণের সামনে দাখিল করে এবং মুগ্ধ সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে চতুর্দিকে ‘ধন্য’ ‘ধন্য’ রব তুলে এই আলোচনাকে অনিবার্য করেছেন।
এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, ক্ষমতার দম্ভ মমতাদেবীকে গ্রাস করেছে এমন কথা প্রকারান্তরে বলা হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনযাপনে, চালচলনে তাঁর কোনও পরিবর্তন নেই। তাঁর টালির বাড়িতে, নিজের কালো স্যান্ট্রো গাড়িতে, আটপৌরে শাদা শাড়িতে, পদাতিক হাওয়াই চপ্পলে মমতাদেবী নিঃসন্দেহে আগের মতোই আছেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও বিরোধী নেত্রীসুলভ আচমকা সিদ্ধান্তে হাসপাতাল, খাদ্য দফতর, পাইকারি বাজারে আলটপকা পরিদর্শনে তিনি আগের মতোই সকলকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছেন। কিন্তু এতে গ্যালারির প্রচুর হাততালি জুটলেও রাজ্য পরিচালনায় এর কার্যকারিতা নেই। দেখনদারিতে প্রশাসন চলে না।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা দাবি করছেন যে, তাঁদের সরকার ‘টাট্টু ঘোড়া’র মতো চলছে। গতিশীল প্রশাসন অবশ্যই কাম্য। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণই প্রশাসনের গতিশীলতা নিশ্চিত করে না। গতিশীল প্রশাসনের দাবি হল, সমস্যার সার্বিক পর্যালোচনা, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ও পরিণামদর্শিতা। অপরিণামদর্শী দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত ভাবে ‘টাট্টু ঘোড়া’র মুখ থুবড়ে পড়া অনিবার্য করবে। যে চারটি বড় সমস্যার চটজলদি সমাধান ৯০ দিনের মধ্যেই করে ফেলেছেন জানিয়ে মমতাদেবী ‘ক্রেডিট’ দাবি করেছেন, সেগুলিকে একটু তলিয়ে দেখলেই এই সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কর্মোদ্যম। স্কুলে মিড ডে মিল বিতরণে মুখ্যমন্ত্রী।
এক, মমতাদেবী দাবি করেছেন যে, জি টি এ চুক্তি দিয়ে তিনি পাহাড়ের সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। এ কথা ঠিক যে, এই চুক্তির পর এত দিন লাগাতার বন্ধ-বিক্ষোভে অশান্ত পাহাড় আপাতত শান্ত রয়েছে এবং পর্যটন গতি পেয়েছে। এ কথাও ঠিক যে, গণতন্ত্র ছোট-বড়, নতুন-পুরনো, সকল জাতি ও জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। তাই উগ্র বাঙালিয়ানার ‘বাংলা ভাগ হতে দেব না’ হুঙ্কারকে পাত্তা না-দিয়ে দার্জিলিং জেলার গোর্খা অধ্যুষিত তিনটি মহকুমাকে নিয়ে গোর্খাল্যান্ড চুক্তিতে দোষের কিছু নেই। খুঁত একটাই। পাহাড়ের মূল অধিবাসী লেপচাদের, যাঁরা নাকি জনসংখ্যার ২০ শতাংশ, বিবেচনায় না-আনা কোনও মতেই ঠিক হয়নি। কিন্তু জি টি এ চুক্তির মূল গণ্ডগোল হল, পাহাড় ছেড়ে তরাই-ডুয়ার্সে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দাবিকে প্রকারান্তরে মান্যতা দিয়ে কমিটি গঠন করা এবং পিনটেল ভিলেজকে চুক্তি সম্পাদনের স্থান নির্বাচন করা। আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ও সমতলের অধিবাসীদের বিক্ষোভের ভিত্তিতে বলা যায় যে, এর ফলে আসলে জি টি এ চুক্তি হয়ে উঠেছে এমন এক টাইম বোমা, যা যে কোনও সময়ে বিস্ফোরিত হয়ে পাহাড়ের শান্তিকে খান খান করে দেবে। এ থেকে অনায়াসে বলা যায় যে, আজ যাঁরা শান্ত পাহাড়ে পর্যটনের ঢল দেখে বিগলিত হচ্ছেন, অচিরেই তাঁদের হাসি মুছে যাবে এবং দার্জিলিং দূর অস্ত্, শিলিগুড়ি পেরিয়ে তরাই-ডুয়ার্সে পা রাখাই দুষ্কর হয়ে উঠবে।
দুই, বিধানসভায় সিঙ্গুর বিল পাশ করিয়ে মমতাদেবী দাবি করেছিলেন যে, অচিরেই অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু ঘটনার গতি বিপরীতমুখী হয়েছে। যে দ্রুততার সঙ্গে বিলটি পাশ করা হয়েছে এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা হয়েছে, তাতে প্রশ্নটির ন্যায়-অন্যায় বিচার ছাপিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রকট হয়েছে। প্রত্যাশিত ভাবেই টাটারা আদালতে গেছেন। সেখানেও অনিচ্ছুক কৃষকদের দাখিল করা আবেদনপত্র খতিয়ে দেখে সরকারি আধিকারিকই জানিয়েছেন যে, অনিচ্ছুক কৃষকদের সংখ্যা মাত্র ৩১০ জন। আর তাঁদের জমির পরিমাণ মাত্র ৪০ একর! অনিবার্য হচ্ছে এই প্রশ্ন এই যে, তা হলে আর এত জল গড়ানো কেন? হাইকোর্টের রায় যেমনই হোক, টাটারা যে সুপ্রিম কোর্টে যাবেই, সে কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা এখন বিশ বাঁও জলের তলায়।
তিন, জঙ্গলমহলে শান্তি আনার লক্ষ্যে মুখ্যমন্ত্রী প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু মুশকিল হল, পঞ্চায়েতের মতো জনগণের নির্বাচিত সংস্থাগুলির আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন ছাড়া এই প্যাকেজ কোনও কাজে দেবে না প্যাকেজের গুড় ইঁদুরে খাবে। বলতে নেই, সেই ইঁদুরের সংখ্যা কোনও রাজনৈতিক দলেই, তৃণমূল কংগ্রেসেও কম নেই। আগের সরকারের উন্নয়নের প্যাকেজগুলি এ ভাবেই ইঁদুরে খেয়ে গেছে। এর যে সমাধান মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, তা এক কথায় অনবদ্য। যে থানাগুলির বিরুদ্ধে মানুষের হাজারো অভিযোগ, সেই থানা থেকে প্যাকেজের চাল বিতরণের ব্যবস্থা হয়েছে! অন্য দিকে, প্যাকেজ দিয়ে মাওবাদী সমস্যা মিটবে না। মাওবাদীরা প্যাকেজের জন্য নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য লড়ছেন। বরং তাঁদের বাদ দিয়ে এ ভাবে প্যাকেজ বিতরণের আসল উদ্দেশ্য যে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করা, তা বুঝতে তাঁদের দেরি হয়নি। ফলে মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এর ওপর নির্বাচনের আগে যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের ও আজাদের মৃত্যুর তদন্তের দাবি নিয়ে এখন মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চুপ। রাজনীতিতে নীরবতা বেশ বাঙ্ময় সব সময়েই কথা বলে। এই নীরবতার তাৎপর্য বুঝে মাওবাদীরা আবার নেমে পড়েছেন। ফলে জঙ্গলমহলে মুখ্যমন্ত্রীর শান্তি প্রয়াস এখন গভীর গাড্ডায়।
চার, রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির যে ব্যাখ্যা মুখ্যমন্ত্রী এখন দিচ্ছেন, তা মানুষের প্রত্যাশার সঙ্গে তো মেলেই না, ১৯৭৭ সালে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের অবস্থানের সঙ্গে তার গুণগত পার্থক্য চোখে পড়ছে। বামফ্রন্ট তখন দলমতনির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়। সে মুক্তির অর্থ ছিল কেস তুলে নেওয়া, জামিন নয়। এখন মুখ্যমন্ত্রী আর নিঃশর্ত মুক্তির কথাই বলছেন না, বলছেন রিভিউ কমিটির কথা। এখন মুক্তির অর্থ জামিন পাওয়া সেই জামিনও পেয়েছেন এ পর্যন্ত মাত্র ৪ জন, মতান্তরে মাত্র ১৩ জন। এখানে মমতাদেবীর সাফল্য একটাই। এ যাবৎ নিঃশর্ত বন্দিমুক্তি আন্দোলনের বাঘা-বাঘা নেতাদের তিনি শর্তযুক্ত জামিন অর্থাৎ ‘মুচলেকা’র পক্ষে ওকালতিতে নামিয়ে দিতে পেরেছেন। মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় এই মধ্যস্থতাকারীদের যে কোনও গুরুত্বই নেই, সেই নির্মম সত্য অচিরেই বোঝা যাবে।
এ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রেও এতাবৎ কাজের খতিয়ান স্পষ্ট করে দিয়েছে এই সত্য যে, এই সরকারের প্রচারে গলাবাজি যত আছে, আসল কাজকর্মে ততটা দায়িত্বশীলতা বা কর্মদক্ষতা নেই। নির্বাচনী ‘ভিশন ডকুমেন্ট’-এ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী ২০০ দিনের কাজের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছিলেন। অর্ধেকের বেশি সময় কেটে গেলেও কাজ কিন্তু এগোয়নি। এ সব কাজের জন্য এতাবৎ ৪০টি কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটি সদস্যরা নিয়মিত ভাতা, সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অচলাবস্থা বিরাজমান মহাকরণে কোনও ফাইলই নড়ছে না। মন্ত্রীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাঁদের কিছু করার উপায় নেই। ব্যক্তিগত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী খুবই কর্মোদ্যোগী, কিন্তু টিম ছাড়া প্রশাসন চালানো যায় না। এই প্রশাসন অনিবার্য ভাবে আমলা-নির্ভর হয়ে পড়বে, মন্ত্রীরা আমলাদের হাতের পুতুল হবেন। এই অবস্থার যদি পরিবর্তন না হয়, তবে ব্যক্তিগত শত উদ্যোগ সত্ত্বেও মমতাদেবী ব্যর্থ হবেন।
কেউ কেউ বিধান পরিষদ গঠনের চিন্তা থেকে সরে আসা বা রাজ্যের নামকরণে ঐকমত্য গঠনে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা উল্লেখ করে ইতিবাচক ছবি তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। এগুলি সত্য। কিন্তু তাতে এই সরকারের দিশা ও কর্মপদ্ধতির ভ্রান্তির অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আসলে, দিল্লি যেতে হলে দিল্লির ট্রেনই ধরতে হবে, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কামরায় উঠে দিল্লি যাওয়ার খোয়াব যতই দেখা হোক, দিল্লি দূর অস্ত্ থাকবে।
মমতা সরকারের এই অবস্থা দেখে বামফ্রন্ট, বিশেষ ভাবে সি পি আই এম নেতারা অবশ্যই পুলকিত হচ্ছেন। ধৈর্য ধরার নাটক ছেড়ে তাঁদের অনেকেই এখন ‘অনেক হয়েছে, আর নয়’ আওয়াজ তুলে ময়দানে নেমে পড়তে চাইছেন। কিন্তু তাঁদের এত পুলকিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, তাঁদের প্রতি মানুষজনের রোষ এখনও এতটাই তীব্র যে, তাঁদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের কথা কেউ আমলই দিচ্ছেন না। ঘটনা হল, ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাদের সন্ত্রাস, দলবাজি, দুর্নীতি, জরিমানা আদায়, মাতব্বরি দেখেও মানুষজন সি পি আই এম-সহ বামপন্থীদের কাছ ঘেঁষছেন না। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাসের শিক্ষা হল, রেজিমেন্টেড দলগুলি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ক্ষমতাসীন বিরোধীরা হতমান হলেও এখন পর্যন্ত কোনও দেশে রেজিমেন্টেড দল ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেনি। রাজনীতির নবীকরণই তাদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে। এখানেও গণতন্ত্র ও বামপন্থার মিলন ছাড়া বামপন্থা লোকগ্রাহ্য হবে না।
এই নবীকরণ কোনও প্রসাধনী বা ভঙ্গিসর্বস্ব ব্যাপার নয়। এটা পার্টি-কাঠামো অবিকৃত রেখে সংস্কারের ব্যাপার নয়, নতুন আঙ্গিকে পার্টি পুনর্গঠনের বিপ্লবী কার্যক্রম, যা বিদ্রোহ ছাড়া সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গের এই বাস্তবতা প্রকাশ কারাট বা ইয়েচুরির বোঝার কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের বোঝার কথা, আক্ষেপের বিষয় হল, সব বুঝেও তাঁরা কোনও ঝুঁকি না নিয়ে পার্টির কোটরে নিরাপদ আশ্রয় সন্ধানে রত।
তাই দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই দিশাহীন নৈরাজ্যের অন্ধকারে রাজ্যবাসীকে আরও বহু দিন কাটাতে হবে। এটাই আপাতত পশ্চিমবঙ্গের ললাটলিখন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.