|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
অথ মিত্র কথা |
কূটনীতিতে জয় দুই প্রকার, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ জয় চোখে দেখা যায়, মুখে বলা যায়। আরও এক প্রকারের জয় হইতে পারে, যাহা উপরিতলে দৃশ্যমান হয়, সর্বসময়ে স্বীকৃত হয় না, কিন্তু তাহা রহিয়াছে, প্রবল ভাবেই রহিয়াছে। অতি সম্প্রতি ভারতের কূটনীতির ভাণ্ডারে এমনই একটি পরোক্ষ জয় জমা হইল। তাহা পাকিস্তান-সম্পর্কিত। এই মুহূর্তে পাকিস্তানের সহিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে ভয়ঙ্কর কূটনৈতিক সংঘর্ষ চলিতেছে, তাহার মধ্যে ভারতের নামটি উচ্চারিত হইতেছে না, কিন্তু দুই বিবদমান পক্ষই সম্যক ভাবে জানে যে তাহাদের দুই জনের বাহিরে আরও এক পক্ষ আছে, এক অলক্ষ্য পক্ষ: তাহার নাম ভারত। ঘটনা এই যে, এত দিন ধরিয়া ভারত যাহা যাহা বলিয়া আসিয়াছে, যাহা যাহা বলিবার জন্য ভারত দীর্ঘ কাল ধরিয়া প্রভূত উপেক্ষা বা ব্যঙ্গ বা ভর্ৎসনা সহ্য করিয়াছে, ঠিক সেই কথাগুলি আজ দিল্লির বদলে ওয়াশিংটনের মুখে শোনা যাইতেছে উচ্চারণ করিতেছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ওসামা বিন লাদেন হত্যার পর হইতেই পাক-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিপর্যস্ত। পাক সামরিক প্রতিষ্ঠান ও সরকার, উভয়ের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, তাঁহারা ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট কড়া হইতেছেন না বলিয়াই জঙ্গি দমনের কাজটি অগ্রসর হইতে পারিতেছে না। সম্প্রতি কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের উপরে যে হামলা হইয়া গিয়াছে, তাহার পশ্চাতে হকানি নেটওয়ার্ক-এর ভূমিকা এবং দায়িত্ব বিষয়ে ওয়াশিংটন নিশ্চিত। এবং একই সঙ্গে, আমেরিকা এই বিষয়েও প্রায় নিশ্চিত যে পাক গোয়েন্দা দফতর আই এস আই-এর সঙ্গে হকানি নেটওয়ার্কের বেশ ঘনিষ্ঠ সংযোগ। এমতাবস্থায় আফগান তালিবানের এই পাক সহচর জঙ্গি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইসলামাবাদ কোনও পদক্ষেপ না লইলে আমেরিকার পক্ষেও সাফল্য অর্জন কঠিন: ওয়াশিংটনের কড়া বার্তা। ইসলামাবাদের অবশ্য এক রা: এই অভিযোগ মিথ্যা অভিযোগ, আমেরিকা নিজ অসাফল্য ঢাকিতে এখন ইসলামাবাদের কাঁধে দোষ চাপাইতেছে, ইত্যাদি। ভারতের মাটিতে সন্ত্রাস প্রসঙ্গেও ঠিক যে ভাবে নিজের দায় ঢাকিতে আক্রমণাত্মক হইয়া ওঠে পাকিস্তান, আমেরিকার বিরুদ্ধেও সেই ভাবটিই দেখা যাইতেছে। মার্কিন দেশে সফররত পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার হুমকিও দিয়াছেন যে আমেরিকা এই পথে আগাইলে ‘বন্ধু-বিচ্ছেদ’ ভিন্ন পথ নাই।
আপাতত পরিস্থিতি যেমন, তাহাতে এই হুমকিতে ভবি ভুলিবে বলিয়া মনে হয় না। মঙ্গলবার মার্কিন কংগ্রেসে পাকিস্তানের সমস্ত রকম আর্থিক সহায়তা দ্রুত বন্ধ করিবার লক্ষ্যে প্রস্তাব জমা পড়িয়াছে। প্রস্তাব পাশ হইয়া আইনে পরিণত হইতে এখনও কিছু পথ অতিক্রম বাকি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় হইতে ঘনিষ্ঠ মিত্র এই দুই দেশের সম্পর্কে ইতিহাসে ইহার অপেক্ষা কৃষ্ণতর দিবস আসে নাই। মার্কিন সহায়তা সরিয়া গেলে ইসলামাবাদ কী ভাবে তাহার অর্থনীতি সামলাইবে, কী ভাবে তাহার প্রবল সামাজিক অবিন্যস্ততার মোকাবিলা করিবে, তাহা বোঝা দুষ্কর। এক দিকে জঙ্গি চাপ, অন্য দিকে চিনা কূটনীতির আগ্রাসন লইয়া আমেরিকার অবস্থাও ভাল নয়, পাকিস্তানকে ত্যাগ করিলে আরও অতল সমস্যায় তলাইবারই সম্ভাবনা। তবে এই পরিস্থিতিতে ভারতের স্বস্তিবোধ করিবার বিস্তর কারণ আছে। বহু দিন ধরিয়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের প্রতি ইসলামাবাদের সরকারি সদয়তার যে অভিযোগ দিল্লি করিয়া আসিতেছে, আজ আমেরিকা হাতে-নাতে তাহার ভুক্তভোগী। শেষ পর্যন্ত দুই ‘প্রাক্তন’ মিত্র কোথায় গিয়া দাঁড়ায়, কী ভাবে বিরোধের অবসান ঘটায়, তাহা দেখিবার। তত ক্ষণ এই পরোক্ষ জয়ের মুহূর্তটি দিল্লি উপভোগ করিতে পারে। |
|
|
|
|
|