ক্ষমতা নয়, মতাদর্শই মূল কথা, বলবে কারাটের নথি
ছ’বছর আগে সিপিএমের দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে ঠিক হয়েছিল, দলের ক্যাডারদের মধ্যে ‘শ্রেণিচেতনা তৈরি করতে’ একটি ‘মতাদর্শগত নথি’ প্রস্তুত করা হবে। এত দিন সেই নথি তৈরির সময় পাওয়া যায়নি। এ বার পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসানের পর সেই কাজ শুরু করেছে সিপিএম। আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবার দিল্লিতে সিপিএমের পলিটব্যুরো বৈঠক। সেখানে ওই নথির প্রাথমিক খসড়া নিয়ে আলোচনা হবে। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট বলেন, “আশা করছি, আগামী পার্টি কংগ্রেসে ওই নথি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।”
২০০৫ সালে দিল্লি পার্টি কংগ্রেসে দলের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন কারাট। তার পর কোয়ম্বত্তূর পার্টি কংগ্রেস হয়েছে। এপ্রিলে কোঝিকোড়ে ফের বসবে পার্টি কংগ্রেস। তার আগে কেন ছয় বছর আগের পার্টি কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত ধুলো ঝেড়ে বের করা হল?
দলের নেতাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘ বাম শাসনের অবসানের পর দলের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি কংগ্রেস ও তৃণমূলের একজোট হওয়া ঠেকাতে ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তি সমর্থন করে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে থেকে যাওয়াই উচিত ছিল? কারণ, সোজা হিসেবে, সমর্থন প্রত্যাহারের ফলে বিরোধী ভোট একজোট হওয়াতেই বামফ্রন্টকে হারতে হয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পরে যাঁরা দলে এসেছেন, সেই নবীন প্রজন্মের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নির্বাচনেই হেরে গেলে মতাদর্শ দিয়ে কী হবে!
পরমাণু চুক্তি প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়েছিলেন খোদ কারাট। রাজ্য নেতাদের আপত্তি উপেক্ষা করেই পলিটব্যুরোতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জেরে ওই সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন তিনি। ভোটে বিপর্যয়ের পরে তাঁর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তখন মতাদর্শের কথা বলেই ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন কারাট। কিন্তু দলের সর্বস্তরে যে সেই ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেটা স্পষ্ট। দলের মধ্যে এই ধরনের ‘বিভ্রান্তি’ দূর করতেই ‘মতাদর্শগত নথি’ তৈরির কাজ সেরে ফেলতে চাইছেন কারাট। যেখানে বোঝানো হবে, নির্বাচনে হারজিত থাকেই। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টিকে তার মতাদর্শ থেকে সরলে চলবে না। সেই মতাদর্শ পাল্টে ফেললে অন্য দলগুলির থেকে সিপিএমের পৃথক অস্তিত্বই মুছে যাবে। মুলায়মের সমাজবাদী পার্টি বা লালুপ্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল পরমাণু চুক্তিকে সমর্থন করতে পারে। কিন্তু চিরকাল ‘সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগান তোলা সিপিএমের পক্ষে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি সমর্থন করা সম্ভব নয়। কারণ বাম রাজনীতির ভিত্তিই হল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার ও তার বিরোধিতা চালিয়ে যাওয়া। হতে পারে, আমেরিকা আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার সাম্রাজ্যবাদী ও সামরিক শক্তি এখনও অটুট। সে কথা মাথায় রেখেই তার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে ইউরোপের বাম দলগুলি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ বা সমাজবাদী দলে পরিণত হয়েছে। এ দেশেও বাম নেতাদের সেই পথে যাওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে সিপিএমের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কারাটের যুক্তি, ব্রিটেন, স্পেন, ইতালির মতো দেশে বামপন্থী দলগুলি ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট’ হতে গিয়ে পুরোপুরি ডানপন্থী হয়ে গিয়েছে। তারা এখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অস্তিত্ব স্বীকার করে না। নিজেদের বামপন্থী বলে দাবিও করে না। অন্য দিকে মিশর বা তিউনিশিয়ার সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানে সেখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলির দীর্ঘদিনের আন্দোলন অনুঘটকের কাজ করেছে বলে মনে করছেন কারাট। মতাদর্শগত নথিতে তাই বোঝানো হবে, ‘সাম্রাজ্যবাদী শক্তি’-র সঙ্গে আপস নয়, শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলাটাই বাম রাজনীতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি।
কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে দলে তাঁর প্রতি তৈরি হওয়া অনাস্থা কাটাতে পারবেন কারাট? দলের একাংশ, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের নেতারা মনে করছেন, মতাদর্শ বজায় রেখেও সংসদীয় রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে সিপিএম-কে নতুন দিশা খুঁজতে হবে। কারাট তা দেখাতে পারছেন না। উল্টে তাত্ত্বিক কচকচানিতেই আটকে থাকছেন। নিজেদের পাল্টাতে না পারলে সিপিএম-কে ধুয়েমুছে যেতে হবে বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তা সেই মনোভাবেরই প্রকাশ বলে দাবি করছেন তাঁরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বারের পলিটব্যুরো বৈঠকেও বুদ্ধবাবু থাকছেন না। সেই অস্বস্তি নিয়েই মতাদর্শগত নথি তৈরি করতে বসতে হচ্ছে প্রকাশ কারাটকে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.