নিজেদের সংগঠন ধরে রাখতে না-পারলে শুধু তৃণমূলকে দোষারোপ করে যে লাভ নেই, এ রাজ্যের যুব প্রতিনিধিদের প্রকারান্তরে ফের তা স্মরণ করিয়ে দিলেন যুব কংগ্রেস নেতৃত্ব। তাঁদের স্পষ্ট বার্তা, শক্তিশালী সংগঠনের কোনও বিকল্প নেই। রাজ্য-সফরে এসে আগেই যে বার্তা দিয়ে গিয়েছিলেন যুব নেতা রাহুল গাঁধী।
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সংগঠনের নানা স্তর থেকে লোকজনের তৃণমূলে চলে যাওয়ার ঘটনায় সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেস নেতৃত্ব যে ‘উদ্বিগ্ন’, যুবদের সাম্প্রতিক একটি শিবিরে তা ধরা পড়েছে। যুব কংগ্রেসের জাতীয় স্তরের পদাধিকারী (এনওবি) নিয়োগের জন্য সংগঠনের অভ্যন্তরেই পরীক্ষা চলছে এখন। হরিয়ানার সুরজকুণ্ডে গত সপ্তাহে এমনই এক পরীক্ষা শিবিরে এ রাজ্যের প্রতিনিধিদের কাছে সেই পরীক্ষায় প্রশ্ন ছিল, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ছেড়ে যে ভাবে নেতা-কর্মীরা চলে যাচ্ছেন অন্য দলে, তার ব্যাখ্যা কী? ছাত্র পরিষদের সভাপতি (সৌরভ চক্রবর্তী) দীর্ঘ দিন সংগঠন করার পরে দল ছেড়ে চলে গেলেন, যুব স্তরেও বিভিন্ন জেলা থেকে দলত্যাগের খবর এল। কেন এই অবস্থা? সংগঠনকে পোক্ত করার জন্য যুব প্রতিনিধিদের মতামতই বা কী?
প্রদেশ নেতৃত্বের একাংশের অভিযোগ, রাজ্যে জোট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বড় শরিক তৃণমূল ‘মেরেধরে’ কংগ্রেসকে ‘গ্রাস’ করে নিচ্ছে। জোট সরকারের শরিক হয়েও তৃণমূলের ‘সন্ত্রাসে’র শিকার হতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। এই নিয়ে দিল্লি গিয়ে খোদ রাহুলের কাছেও দরবার করে এসেছেন রাজ্য কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদল। কিন্তু যুব কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব যে কোনও ‘অজুহাত’ শুনতে নারাজ এবং সংগঠন ভেঙে পড়ায় উদ্বিগ্ন, সেই বার্তাই ওই পরীক্ষার প্রশ্ন থেকে উঠে এসেছে।
তৃণমূলকে ‘দোষারোপে’র প্রবণতা যে বিনা যুক্তিতে মেনে নেওয়া হবে না, তা আগেও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন খোদ রাহুল। মালদহের এক যুব নেত্রী তথা বিধায়ক যুবদের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অভিযোগ করেছিলেন, তৃণমূলের হাতে কংগ্রেস মার খাচ্ছে। রাহুল পাল্টা জানতে চান, নন্দীগ্রামে আন্দোলনের সময় তাঁরা কোথায় ছিলেন? সিঙ্গুরের আন্দোলনের সময়ই বা তাঁদের কী ভূমিকা ছিল? তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তায় নেমে সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেই রাজ্যের ক্ষমতায় গিয়েছেন, এই ‘সহজ সত্য’ তাঁরা যেন ‘দোষারোপ’ করার আগে মনে রাখেন! যুব কংগ্রেসের ভাবী এনওবি-দের পরীক্ষাতেও সেই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে দলীয় সূত্রের খবর।
সুরজকুণ্ডের ওই পরীক্ষা শিবিরে কংগ্রেসের বিধায়ক-সহ এ রাজ্য থেকে ১৬ জন ছিলেন। পরীক্ষক হিসাবে ছিলেন মীনাক্ষি নটরাজন, জিতেন্দ্র সিংহের মতো ‘রাহুল-ঘনিষ্ঠ’ পদাধিকারীরা। উত্তরে রাজ্যের প্রতিনিধিরা তাঁদের মতো করে কংগ্রেসের ‘সমস্যা’ তুলে ধরেন। কেউ লিখেছেন, সংগঠনের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করলে তাঁরা দলে ‘গুরুত্ব’ পাবেন বলে যুবদের বলা হয়েছিল। অথচ বিধানসভা ভোটে টিকিট বণ্টনের সময় তা মানা হয়নি! কেউ জানান, নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সংগঠনকে শক্তিশালী করতে বলেও কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব বিধানসভা ভোটে মমতার শর্তে আসন সমঝোতায় রাজি হয়ে যান। কিন্তু কংগ্রেসের যে আরও আসনে লড়ার ‘যোগ্যতা’ ছিল, ভোটের ফলাফলেই তা প্রমাণিত। দলীয় নেতৃত্বের কথা দলেই কার্যক্ষেত্রে লঙ্ঘিত হলে ছাত্র ও যুবরা সংগঠন করতে উৎসাহী হবেন কেন, প্রকারান্তরে এই বক্তব্যই উঠে এসেছে প্রতিনিধিদের বিশ্লেষণে।
শিবিরে অংশগ্রহণকারী এক কংগ্রেস বিধায়কের কথায়, “রাহুল’জি বারেবারেই একটা জিনিসে জোর দিচ্ছেন সংগঠন। অন্য দলের সঙ্গে তুলনা না-করে নিজেদের সংগঠন মজবুত করার কাজটাই মন দিয়ে করতে বলা হচ্ছে সব শিবিরে।” বিধানসভা কেন্দ্র ধরে ধরে যুব কংগ্রেসের প্রশিক্ষণ শিবির এখনও চলছে। সংগঠনকে তৃণমূল স্তরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে পুজোর পরে হবে পঞ্চায়েতি রাজ সম্মেলন। ডিসেম্বরের মধ্যে সাংগঠনিক কর্মসূচিতে রাহুলেরও রাজ্যে আসার কথা প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে।
প্রদেশ কংগ্রেসের এক নেতার দাবি, “তৃণমূল অনেক জায়গাতেই কংগ্রেসের সংগঠন গ্রাস করেছে, এটা ঠিক। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। এখন যেমন কংগ্রেস ছেড়ে অনেকে তৃণমূলে গিয়েছে, তেমন ভবিষ্যতে তৃণমূল ছেড়ে নিচু তলায় কংগ্রেসে আসার সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।” পক্ষান্তরে তৃণমূলের এক যুব নেতার বক্তব্য, “সম্মান এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে পদ নিয়ে সমস্যার জন্যই অনেকে কংগ্রেস ছেড়েছেন। কিন্তু শুধু দলের কর্মীসংখ্যা বাড়লেই হবে না। সংগঠন তৈরি করতে হবে আমাদেরও। দলে সাংগঠনিক নির্বাচন হয় পাঁচ বছর অন্তর। এবার তা হওয়ার কথা। তার কাজ পুজোর পরেই শুরু হবে।” |