শান্তিতে ঘুমোও, জানি না কী বলে ডাকব তোমায়
“তোমাকে কী বলে ডাকব আমরা?”
পটৌডির নবাবকে প্রশ্নটা করেছিলাম মইন-উদ দৌল্লা গোল্ড কাপে খেলার সময়। আমরা খেলছিলাম ওয়াজির সুলতান কোল্টসের হয়ে। সালটা ১৯৬৬।
“তোমাকে স্কিপার ডাকব না ক্যাপ্টেন? না নবাব সাহেব? না প্যাট? না টাইগার?” এটা ছিল আমার পরের প্রশ্ন।
আমি একটা রান আউট করেছিলাম। পটৌডি আমায় বাহবা দিয়ে নিজের জুতোর ফিতে বাঁধতে বসেছিল। তখনই সাহস করে প্রশ্নগুলো করে ফেলেছিলাম। এই দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে পড়েছিল, কারণ আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম, যে প্রথম উইকেট নেবে তাকেই এই প্রশ্নটা করতে হবে। দলে টেস্ট ক্রিকেটার বলতে ছিল একমাত্র ও। আমরা আর সবাই কচিকাঁচা, মাঠে কিছু একটা করে দেখাতে মরিয়া। আগের সন্ধেয় জোর আলোচনা করেও ঠিক করতে পারিনি ওকে ঠিক কী বলে ডাকব। ম্যাচ শুরুর আগে প্রশ্নটা করার মতো সাহসও কারও ছিল না। টসের মাত্র কয়েক মিনিট আগে ক্রিকেটের পোশাক পরেই মাঠে এল। সঙ্গে কোনও কিট নেই। কিছুক্ষণ পা ম্যাসাজ করিয়ে টস করতে গেল। টস হেরে এসেই আবার ম্যাসাজ নিতে শুরু করল। আম্পায়াররা বেরোনোর সময় ও আমাদের নিয়ে মাঠে নামল। আমরা সবাই ওর অন্তত পনেরো গজ পিছনে।
তখন খেলাটা কত সহজ ছিল! কোনও ঘাম ঝরানো ওয়ার্ম-আপ ছিল না। ‘হাডল’ ছিল না। ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন টিম মাঠে নেমে যেত। প্রত্যেক বিরতিতে পায়ে ম্যাসাজ নেওয়া হত। ও ম্যাসাজ টেবিলে বসত আর ম্যাসিওর পাউডার দিয়ে ম্যাসাজ করত। ওকে অবশ্য এটাই আমার প্রথম দেখা নয়। ১৯৬২-তে ভারতীয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে যাওয়ার সময় মুম্বই পুরসভা যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান করেছিল, সেখানেই প্রথম বার ওকে কাছ থেকে দেখি। তখন অবশ্য আমার ‘আইডল’ জয়সিংহকে দু’চোখ ভরে দেখার আগ্রহটাই ছিল বেশি। দল যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, আমরা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলাম ওদের ওপর। এই নায়কদের ছুঁয়ে থাকা বাতাস বুক ভরে নিতে চাইছিলাম। এখনও মনে আছে, পাগলের মতো উত্তেজনায় বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে সেই সন্ধের প্রতিটা সেকেন্ডের বিবরণ দিয়েছিলাম। ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্নটা সে দিনই একটা জেদ হয়ে গিয়েছিল।
পুরনো অ্যালবাম থেকে। পটৌডির সঙ্গে সস্ত্রীক গাওস্কর।
মনে হয় না দেশে এমন কোনও উঠতি ক্রিকেটার ছিল যে ওর মতো করে হাঁটার চেষ্টা করেনি। ওর মতো স্টান্স নেওয়ার চেষ্টা করেনি। যদিও আমাদের কারওই কলার তোলার সাহস ছিল না। ওটা করলেই ‘চাকু’ তকমাটা গায়ে লেগে যেত। যারা নিজেদের নিয়ে প্রচণ্ড বেশি ভাবত, মুম্বইয়ের ময়দানি ভাষায় তাদের ওই নামে ডাকা হত। টেস্ট ক্রিকেটাররা ছাড় পেত। ওরা ভারতের হয়ে খেলেছে, চাইলে কলার তুলতেই পারে। কিন্তু উঠতিরা কেউ? একদম না!
ওর ‘ওপেন স্টান্স’টা অননুকরণীয়। একটা চোখ হারিয়েছিল বলে ‘ওপেন-চেস্টেড’ হয়ে খেলত, যাতে ভাল চোখটা দিয়ে বোলারকে ভাল করে দেখতে পায়। আমরা সবাই ওটা টুকতে যেতাম আর আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে বোল্ড বা লেগ বিফোর হয়ে ফিরতাম। ওর ফিল্ডিংটা টুকতে পারিনি কারণ ওই সময়ে ও ভাবে স্লাইড করে বল বাঁচাতে একমাত্র ও-ই পারত। ওর ফিল্ডিংটা ছিল ওর ব্যাটিংয়ের মতোই থ্রিলিং। ষাটের দশকে রুসি সুর্তি, চাঁদু ‘প্যান্থার’ বোরডে, আব্বাস আলি বেগ-এর মতো অসাধারণ সব ফিল্ডার ছিল বলে অফসাইডটা চিনের প্রাচীরের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে ভাবলে যে, একটা চোখ নিয়ে ও ব্যাট করত কী করে! কভার বা স্লিপে অত ভাল ক্যাচই বা নিত কী করে! ভেবে দেখুন দু’চোখ থাকলে কী হত! যে রসিকতাগুলো করত, সেগুলো এক লাইনের, কাটা-কাটা। দুর্ঘটনায় চোখ হারানোর পর এক ইংরেজ ওকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কখন আপনার মনে হল যে আপনি আবার সর্বোচ্চ পর্যায়ের খেলায় ফিরতে পারেন?” ও জবাব দেয়, “যখন ইংল্যান্ডের বোলিংটা দেখলাম!” অবাক করার মতো ব্যাপার আরও একটা ছিল। ওর নিজস্ব কোনও কিট ছিল না। যদি থেকেও থাকত, তা হলে ও কখনও সেটা মাঠে আনত না। ব্যাট করতে নামার সময় যে গ্লাভসটা বা ব্যাটটা হাতের কাছে পেত, সেটা নিয়েই মাঠে নেমে পড়ত আর রান করত। তখনকার দিনে তো আর স্পনসররা ডজনখানেক করে ব্যাট দিত না। আমাদের নিজেদেরই ব্যাট কিনতে হত। যার ব্যাট নিয়ে ও খেলতে নামত, তার বুকের ধুকপুকুনি শুরু হয়ে যেত। কিন্তু ও রান পেলে (সাধারণতই যেটা হত) সে-ই আবার বুক ফুলিয়ে বলে বেড়াত যে, ওর ব্যাট দিয়ে খেলেই তো রানটা হয়েছে!
ষাটের দশক ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের গ্ল্যামারাস একটা যুগ। ও, জয়সিংহ, ইঞ্জিনিয়ার, বুধি কুন্দরন, আব্বাস আলি, হনুমন্ত সিংহ, সেলিম দুরানিদের মতো সুপুরুষ সব ক্রিকেটাররা খেলত। আমরা উঠতি ক্রিকেটাররা শুনতাম মাঠের বাইরে ওদের কীর্তিকলাপের গল্প। কী ভাবে ওরা অসাধারণ সুন্দরী মহিলাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। কী ভাবে ফিল্মস্টার, মডেলরা ওদের পেছনে পড়ে থাকত। এ সব গল্প ওদের কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। আমরাও হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। এখনকার উঠতি ক্রিকেটাররা বোধহয় সচিন, ধোনি, যুবরাজ, সহবাগদের গাড়ি, বাড়ি, ঘড়ি, জামাকাপড়ের দিকে এই ভাবে তাকিয়ে থাকে।
সবাই জানত ও প্লেনে চড়তে ভয় পেত। বাইরে কোথাও খেলতে গেলে ট্রেন বা গাড়িতেই যেতে চাইত। কিন্তু বিদেশ সফরে গেলে তো প্লেনে উঠতেই হত। যার জন্য চেক-ইন করার পর থেকে কড়া কয়েকটা পেগ খেয়ে নিজেকে তৈরি করে রাখত। মনে আছে এক বার কেনিয়া থেকে ফেরার সময় খুব খারাপ আবহাওয়ায় পড়ে গিয়েছিলাম। প্লেনটা বুনো ঘোড়ার মতো লাফাচ্ছিল। ওর অবস্থা খারাপ। আমিও ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছি। হঠাৎ খেয়াল হল, মাঝরাত পেরিয়ে একটা নতুন দিন শুরু হয়েছে। নিজের নার্ভাস ভাবটা কমাতে ওকে আরও একটু ভয় পাওয়াব ভাবলাম। যেন কিছুই হয়নি, এমন একটা ভাব করে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার জন্মদিনে তোমার বাবা মারা গিয়েছিলেন না? জানো, মাঝরাত পেরিয়ে গিয়েছে। তার মানে আজ স্যাফের জন্মদিন। হয়তো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে!” আমার কথা শুনে ওর মুখটা কী রকম হয়ে গিয়েছিল, আজও মনে আছে।
১৯৭৪-’৭৫ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে আমাকে সহ-অধিনায়ক করার প্রস্তাব ও-ই দিয়েছিল। প্রথম টেস্টের আগের দিন রাজ সিংহের সঙ্গে এসে ও আমাকে সেটা জানিয়ে গেল। তবে ভারতীয় ক্রিকেটের যা নিয়ম, আমাকে বলা হল খবরটা কাউকে না জানাতে। তার পর একটা ক্যাচ নিতে গিয়ে চোট পেয়ে ও যখন মাঠ ছাড়ল, তখন গোটা একটা ওভার ধরে সে এক বিভ্রান্তি। শেষ পর্যন্ত নির্বাচকরা জানালেন, আমাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। ওই সিরিজটার পরেই ও অবসর নেয়। তার পর ক্রিকেট থেকে বরাবর একটা দূরত্ব রেখে গিয়েছিল। এটা ভারতীয় ক্রিকেটের ক্ষতি, যে ওর অভিজ্ঞতা আর ক্ষমতাটা কাজে লাগানো গেল না। মিডিয়ায় কিছু কাজ করলেও সেটায় ওর খুব মন ছিল না। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের মিটিংয়ে ওর সঙ্গে বসে আবার সেই এক লাইনের মন্তব্যগুলো শুনতে পেতাম। মিটিংয়ের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে মাঝেমধ্যে মজা করত।
ওকে ভীষণ মিস করব। ও যা-ই করত, তার মধ্যে একটা আভিজাত্য, একটা জাঁকজমক ছিল। আর অবসরের পরেও ওকে ঘিরে রয়ে গিয়েছিল একটা রহস্যের বলয়। ওর পরিবারের লোকেরা ছাড়া আর কেউই বোধহয় বলতে পারবে না যে, সে ওকে খুব ভাল করে চিনত।
বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, সে দিন আমার সেই প্রশ্নটার জবাব ও দেয়নি। এক বার মাথা তুলে আমাকে দেখল। তার পর উঠে পড়ল। ওকে কী বলে ডাকব, সেটা আর আমাদের জানা হয়নি। ওকে এত বছর চিনি, তা-ও আমি জানি না ওকে কী বলে ডাকব।
শান্তিতে ঘুমোও স্কিপার, ক্যাপ্টেন, নবাব সাহেব, প্যাট, টাইগার। তোমার মতো আর কেউ কোনও দিন হবে না।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.