|
|
|
|
|
|
|
রাম! রাম! |
বাণী বসু |
আরে কৌন হ্যায় রে তু? তাঁর সুখশয্যায় বৃদ্ধ ডালমিয়া আনচান করে উঠলেন। দিব্যি ঘুমোচ্ছিলেন, একটি চমৎকার দিবানিদ্রা, তাঁর সুপুত্র বলেছে এই নিদ্রায় কোনও দোষ নেই, সভ্য দেশের লোকেরাও এটা মানে, তাই তার নাম দিয়েছে সিয়েস্তা। তিনি তো জীবনে কোনও দিন অবসর কী, আরাম বিলাসিতা কী, জানলেন না, আলস্যকে হারাম মনে করে এসেছেন বরাবর। কামকাজে আদমি জিন্দা থাকে। তার পাকিট ভি জিন্দা থাকে, পৈসার বাচ্চা ভি পয়দা হয় পাকিটে, আর পৈসা না থাকলে জিন্দেগি কী? কেন?
সাতাশি পার হয়ে গেল। কোনও দিনই তিনি খুব খুবসুরৎ, লম্বা-চওড়া ছিলেন না। এখন হয়ে গেছেন আরও ক্ষয়া-খপ্পুরে, মাথাটা লোহার আলুর মতো, তাতে গুনে গুনে তিন গাছা চুল। মুখটা মাংসল, অথচ তুবড়ে গেছে। তবে মাহিন্দর ডালমিয়া যেহেতু অল্প বয়সেও কখনও সিসায় নিজের চেহারা দেখার গুনাহ করেননি, তাই এখন দেখলেও তিনি তফাতটা ধরতে পারবেন না, চিনতেই পারবেন না, হয় তো বলে বসবেন কৌন হ্যায় এ বুডঢা বুরবক, যেমনি এর সুরত, তেমনি এর তাকত, একে খবরদার কামে বহাল করিসনি বেটা।
তখন তাঁর সুপুত্র যোগিন্দর, এখন তাঁর কারবারের মালিক যদি বলে রাম রাম পিতাজি, আপ নে তো সত্যনাশ কর দিয়া। মেমরি হাপিশ হয়ে যায় সেই আলঝাইমার হল নাকি আপনার? খুদকো চিনতে পারছেন না? আচ্ছা তাই যেন হল যে আপনি কখনও আয়না দেখা-শিখা করেননি, ইৎনা বুডঢা আদমিকে দিয়ে আমি কাম করাব, এ কথাই বা আপনি সোচলেন কী করে?
তখন বৃদ্ধ ডালমিয়া বিড়বিড় করে বলবেন, কামকাজ না করে জিন্দা থাকাটা ঠিক না।
তা কী হবে তা হলে আমাদের দাদা পরদাদাদের?
বৃদ্ধ বেমালুম বলে দেবেন খতম কর দে বেটা, চুপচাপ খতম কর দে।
এই সময়ে হয় তো তাঁর স্মরণ ক্ষীণ ভাবে কাজ করছিল, তিনি যখন কারোবার ফলাও করছেন বাংলা মুলুকে, তখন ইনদৌরে গাঁওঘরে তাঁর দাদির সাঁস জিন্দা ছিলেন, মাতাজি চলে গেছেন, দাদিজি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর পিতাজির মাতাজি এই বুডঢি আরামসে খাওয়াদাওয়া করছে, রামনাম নিচ্ছে, তার গোড় দাবাতে খাস লোক রাখছে, তো তিনি কী করবেন? তিনি বুডঢিকে একলা রেখেই চলে এলেন, থাকুক সে আরাম করে, চার দিকে ফ্যামিলির চাঁদির বর্তন, তার নিজের লাখো রুপেয়ার গহনা সব আঁকড়ে বসে ছিল বুডঢি। বেমালুম মার্ডার হয়ে গেল। গাঁয়ের লোকজন তাঁকেই দোষ দিতে লাগল, এ ভাবে বৃদ্ধাকে ফেলে যেতে হয়? তো তিনি কী করবেন?
এখন নিদারুণ গর্মি। ঠান্ডা মেশিন চলছে বিশ পয়েন্টে, ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর। তিনি নরম বিছানায় শুতে পারেন না, ডগদরের বারণ আছে, কিন্তু ছেলের স্টেটাসে লাগে, তাই ডবল স্প্রিংয়ের গদির ওপর তাঁর শ্বেতশুভ্র বিছানা। তার ওপর একটা সমান সমান কাঠের তক্তা পেতে তার ওপর আবার পাতলা ম্যাট্রেস দিয়ে তিনি শুয়ে থাকেন। তাই গায়ে হাত-পায়ে ব্যথা বেদনা নেই, খাসা আছেন তিনি, দু’বেলা দুধ, দহি, কচৌরি পুরি হজম করছেন, মটর পনির, গাজর কি হালবা, আগেও যেমন, এখনও তেমন। তবে এ কথা ঠিক নয় যে, তিনি একেবারে অবসর নিয়ে ফেলেছেন। অবসর নিয়ে কী করবেন ডালমিয়াজি? তাঁরা হলেন সেকালের লোক। এখনকার ডালমিয়াদের মতো কলেজ ভার্সিটিতে গিয়ে মেলা পঢালিখা করেননি, বই পড়া, কী গান শোনা, কী নাচ দেখা, এ তাঁর তেমন আসে না। নিজের বাড়িটি ছেড়ে কোথাও গিয়েও খুব একটা শান্তি পান না তিনি। তবে? কী করবেন? করবেন সেই একটা জিনিসই। ধান্দায় মাথা লাগানো। হাতেকলমে করছেন না আর। কিন্তু অ্যাডভাইস দিচ্ছেন। বিজনেস নিউজ পড়ছেন, শুনছেন, কারবারের হালহকিকত জানছেন, আর যোগিন্দরটাকে হদিশ দিচ্ছেন, এ কর বেটা, ও কর বেটা...। সে তো এই বয়সেও তার পিতাজির ক্ষুরধার ব্যবসাবুদ্ধি দেখে, থেকে থেকেই পরণাম করে যায়। এই পিতাজি না থাকলে তার কী যে হবে? রাম রাম!
দুপুরবেলা নিদ্রার আমেজে ছিলেন সিনিয়র ডালমিয়া। কে যেন খসখস করে ঘরে ঘুরে বেড়ায়।
কৌন হ্যায় রে? তিনি শ্লেষ্মাভরা গলায় ফুকরে উঠলেন।
খুব ক্ষীণ স্বরে জবাব এল আমি।
মেয়েলি গলা।
দুবলি নাকি রে? খেতে পাস না? গলায় একটু বা হাসি এনে তিনি বললেন।আপনারা আমায় খেতে দিলে তো?
ফরমান জারি করেছেন তো খেলেদেলে চলবে না! আইসক্রিম না, বাটার না, ঘি না, ভাত না। কী খাব তবে আমি?
আরে বেটি তু বঙ্গালিন, নয়? কৌন হারামখোর এমন আজগবি বাতটা তোকে বলল? মছলি মেখে, ঘিউ মেখে ভাত না খেলে কোন বঙ্গালিনটা বাঁচে রে? আমাদের জনানারা অত ভাত খায় না, কিন্তু ঘিউ মাখা পরেঠা তো হরবখ্ত খাচ্ছে।
একটু হাসির আওয়াজ পাওয়া গেল। আপনি কবেকার কথা বলছেন। এখন আপনাদের জনানারাও ও-সব ঘিউটিউ খায় না। আইডিয়াল ফিগার বানাচ্ছে সব। আমরা তো হেরে যাচ্ছি।
বাপ রে, তবে তো ভারী আফসোস কি বাত হয়ে গেল রে! কম্পিটিশন কি বাত! হরিয়ানি রাজস্থানি লড়কির কাছে বাঙ্গালি লড়কি হেরে যাচ্ছে...
ধ্যাৎ, হেরে যাওয়াটাওয়ার বাত নয়। আপনি আসল কথাটাই বুঝতে পারছেন না। টাকাপয়সা প্রচুর লাগে ওই রকম ফিগার বানাতে। জিমে যাও, ওয়াকিং শু কেনো এতগুলো টাকা দিয়ে, হাঁটো খুব কষে, বেছে বেছে ফল খাও, প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাও, ওগুলোর দাম জানেন? ট্যাবলেট, ক্রিম, কোনওটাতে রোগা হয়, কোনওটাতে ফর্সা হয়... আপনারাই তো বানিয়েছেন ও-সব। এই দেখুন ফর্সা হতে গিয়ে আমার কী হাল হয়েছে। সে একটা ফ্যাকাসে হাত বাড়িয়ে দেয় তাতে ভরা দাগ। বলল, মুখটা আর দেখাব না, চুড়ৈল বলেন না? তেমনি হয়েছে...
একটু ঘাবড়ে গেলেও ডালমিয়া তাঁর খুশ মেজাজ ধরে রাখেন, বলেন, তাই নাকি? আমরা বানিয়েছি, আমিই জানি না? তা এই নালিশ করতেই কি এই বুডঢাটার কাছে দুপুরের ঘোরে এসেছিস?
নালিশ কি একটা নাকি?
রাম রাম! ঔর ভি আছে? তবে তো খুদ ভগোয়ানের কাছেই আমার নামে নালিশটা করতে হচ্ছে রে!
আহা, ভগবান বলে আবার কেউ আছেন নাকি?
এ হি তো! বঙ্গালি লোগ কুছু মানবে না, পূজা ঘর রাখবে না, আর্তি করবে না, তবে আর তাদের সঙ্গে কী কথা করবে এ ডালমিয়া?
কী করে মানবো বলুন! ভগবান যদি ভগবান হবেন তো তাঁর এমন অবিচার কেন? এক জন হবে ফুটফুটে ফর্সা তো আর এক জন হবে কুটকুটে কালো, এক জন সুন্দর তো আর এক জন কুচ্ছিৎ, তাই তো আমাদের ট্যাবলেট খেতে হয়, ক্রিম মাখতে হয়। এক জন পয়সায় লুটোপুটি খাচ্ছে তো আর এক জনের কিচ্ছুটি নেই, এ কী রকম ভগবান? আর এখন আপনারাই তো সেই ভগনাবনের কাজটা করছেন। কে মোটা ছিল তাকে বললেন, ট্যাবলেট খাও সে রোগা হয়ে যাবে, কে বেঁটে ছিল, তাকে বললেন লম্বা হয়ে যাও, সে ম্যাজিকের মতো লম্বা হয়ে যাবে। ...বাস, এইটুকু কথা বলে ঘুমটি একেবারে চটকে দিয়ে গায়েব হয়ে গেল লড়কিটা। গেল তো গেল। খুবই ভাবিয়ে দিয়ে গেল।
সত্যিই তো! ভগবান যদি ভগবানই হবেন, তা হলে তাঁর জগতে এত সাদা-কালো কেন?
কথাটা তিনি অগত্যা ছেলেকেই বললেন।
হ্যাঁ রে যোগিন্দর! এই যে আমরা দানধ্যান করছি, মন্দির বনাচ্ছি, আর্তি করছি, তার টিকা লাগাচ্ছি কপালে, এর মানে কী?
যোগিন্দর তো হা। তার পিতাজির কি মাথা খারাপ হল নাকি?
মন্দির বানানো তো থাকবেই, আরও দু’চারটে করতে পারলে ভাল, পিতাজি যদি তাকে মন্দির বানানোর হুকুম করেন, সে এক্ষুনি লোকলস্কর লাগিয়ে দেয়। জমি কেনা আজকাল খুব হুজ্জুতের কাম হয়ে যাচ্ছে, তা সে সব জমি ঠিক করা, কেনাকাটা, তার পর তার প্ল্যান বানানো, স্যাংশন, আর্কিটেকচার, হাল ফ্যাশন, কোন দেওতার মন্দির চাও লছমিজি না বজরংবলী... কে এখন ফ্যাশনে আছেন ঠিক করা। কাজ কি একটা নাকি? বহোৎ ঝামেলার কাজ। তা সত্ত্বেও তার একটা মানে আছে।
কিন্তু মন্দির করা, দানধ্যান, আর্তি, টিকা লাগানো এ তো জনম জনম করে আসছে সবাই। এই পিতাজিই তো শিখিয়েছেন, নাহা করে সাফসুফ হয়ে আগে ঘরেলু দেওতার কাছে দিয়া দেখিয়ে আর্তি করবি, তার পর দুটো নকুনলদানা পরসাদ মুখে দিয়ে কপালে একটা গোলা সিন্দুরের টিকা একটা কর্পূরের কালো টিকা লাগাবি, বাস, দুনিয়ায় কারও সাধ্য নেই তার কিছু নুকসান করে। সেই পিতাজিই এখন মানে জিজ্ঞেস করছেন এ সবের? ছিয়া ছিয়া ছিয়া! বুঢ়াপে কি পিতাজির দিমাগ একেবারেই খারাব হয়ে গেল?
তবু সে ধৈর্য ধরে। জিজ্ঞেস করে কিঁউ? এমন মনে হবার আপনার কারণটা কী?
ডালমিয়া বললেন আরে বুদ্ধু এটা কখনও সোচ করে দেখেছিস, কালী মায়ির কাছে তো কত জন যাচ্ছে, পূজা চঢ়াচ্ছে, তাতে কারও ভাল হচ্ছে, কারও হচ্ছে না, যে যেখানে আছে সব ভগোয়ানকে ডাকছে, সব মায়ি সব বাপ তবে কেউ ল্যাংড়া লুলা কেউ আন্ধা কেউ গোরা কেউ কালা এমন হবে কেন? এর মানে কী?
ছেলে বলল, পুণ, আগের আগের জনমের পুণ রয়েছে না? আপনার আমার সব জমে গেছে...
এ বার গলা খাটো করে ডালমিয়া বললেন, আর তাইতেই এ জনমে পৈসা কামাবার ধান্দায় বাজার যে দিকে থাকবে, সে দিকে গিয়ে উঠতে হবে? আরে বুদ্ধু, কখনও সোচ করেছিস কি যে, সাফা বনবার ক্রিমটা, পৎলি হবার ট্যাবলেটটা চালু করেছিস, সেগুলোতে কী কেমিকল দিচ্ছিস, তাতে এ লড়কিগুলোর জিন্দগি বরবাদ হয়ে গেলে কে জবাব দেবে রে বেটা? সোচ সোচ।
যোগিন্দর আর একটু হলেই সোফা থেকে সিধে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। আরে সত্যনাশ, এ বুডঢা বলে কী? আজ থেকে দশ গ্যারা বছর আগে সে যখন কারবারে নুকসান খেয়ে একেবারে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিল, এই পিতাজিই তাকে বলেছিলেন, আরে বেওকুফ, ম্যাগাজিন দেখিস?
দেখি!
কী দেখিস?
টেররিজম চার ধারে পিতাজি, লাইফ বহোৎ রিস্কি হয়ে যাচ্ছে।
আরে তু এক কারবারি, জিন্দগি মৌত তোর সোচ নয়, তুই কারবারের দুনিয়ায় কী দেখছিস?
আই টি এসে গেল। উতে তো হমার নো-হাউ নেই।
আরে বেওকুফ, তোর পিতাজি যখন আয়রন থেকে কেমিকলস-এর কারবারে গেল, কীসের ডক্টর ডিগ্রি ছিল রে তার?
যোগিন্দর চুপ। আই টি-তে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। প্রচুর কম্পিটিশন, দেশ-বিদেশের বড় বড় ব্রেনগুলো সব আই টি-র পিছে পড়ে আছে। সেখানে সে কী করবে?
তখন সিনিয়র ডালমিয়া তাকে একটার পর একটা খবরের কাগজ খুলে দেখাতে লাগলেন। সর্বত্র সুন্দরী মেয়েদের ছবি। সুন্দরী যে তাও সব সময়ে নয়। কিন্তু বডি, বডি বডি। ব্রা পরা, প্যান্টি পরা, প্রায় নাঙ্গা, সব বডি পার্টস, হাত পা বুক, কোমর, নিতম্ব... দেখানো শেষ হলে বললেন, ক্যা সমঝা তু?
কুছ নেই পিতাজি! এ সব জনানা ...সরম ভরম কুছ নহী, লালবাত্তি এরিয়া কি কোঠিসে নিকলি আওরত সব, ছিয়া ছিয়া ছিয়া, বললেন বটে কিন্তু আড়চোখে একটু দেখেও নিলেন ঠিকই।
আরে বেটা লালবাত্তি কি রান্ডিকে পাস অ্যায়সি বডি থোড়ি মিলেগি। এহি আজকালকা কারোবার বেটা। তুরন্ত সোচ, ক্যা করনা, ক্যায়সে করনা।
ফিল্ম ইনডাস্ট্রি একটা অতল গহ্বর, যোগিন্দর খুব ভাল করে জানেন, তিনি টাকা জোগাবেন, কিন্তু ডিরেক্টর, ক্যামেরা, অ্যাক্টর মিলে যে ঘ্যাঁট বানাবে, তাতে তাঁর কোনও হাত থাকবে না। বড়জোর হিরোইনকে এক দিন পেলেন নাগালের মধ্যে। তাতে তাঁর ব্যক্তিগত সন্তোষ হয় তো হল, কিন্তু কারবারের কোনও শিয়োরিটি তা থেকে পাওয়া যাবে না। যখন এক সময়ে ব্যবসায় তাঁর প্রফিট উপচে পড়ছিল, তখন ফিল্মের কথা তিনি ভেবেছিলেন, কিন্তু লোভ সামলে নিয়েছিলেন। কেন না, কোটি কোটি টাকার ফিল্ম সব ধড়াধধ্ড় করে পড়ে যায়, এ তাঁর স্টাডি করা জিনিস। এর সব নাকি বড় বড় মাফিয়াদের টাকা দিয়ে এ সব বানায়। তা তিনি তো আর মাফিয়া নয়, যে এত বড় রিস্ক সাধ করে নিতে যাবেন। পিতাজিকে এই সংবাদই তিনি জানালেন।
অনেকক্ষণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন ডালমিয়া। তার পরে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, দীর্ঘশ্বাস না হতাশ্বাস! সে দীর্ঘশ্বাসের ভাষা বুঝলেন অবশ্য যোগিন্দর। পিতাজি তাঁর সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছেন। তাঁর ব্যবসাবুদ্ধিতে মরচে পড়ে গিয়েছে, পিতাজি দেখতে পাচ্ছেন।
মুখ নিচু করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন তো আপকা সোচ ক্যা, বাতাইয়ে না জি!
গলার স্বর আস্তে হয়ে গেল ডালমিয়াজির। তিনি বললেন, এ বডিকো ফায়দা উঠা বেটা, বডি কো ধান্দা বনা।
শুনে তো যোগিন্দরের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড়। পিতাজি শেষ পর্যন্ত তাকে মেয়ে বিক্রির ব্যবসা ধরতে বলছেন? অরক্ষিত সুন্দর সুন্দর মেয়ে! রাম রাম! তার মানে ইন্টারন্যাশনাল পাচার চক্র? তিনি তো বছর না ঘুরতেই ধরা পড়ে যাবেন, জেলে পচবেন জীবনভর। তার ওপর বদনাম! বুডঢাটাকে এখন তো তাঁর একটা ভালু কী ডাকু মনে হচ্ছে! ভাবলেন এত সব, মুখে শুধু বললেন, হায় রাম!
সুন বেটা, বৃদ্ধ ডালমিয়া এতটা না বুঝলেও ছেলে যে ধন্দে পড়েছে, সেটুকু বুঝেছিলেন। ঝানু লোক! তিনি ধৈর্য ধরে এ বার বোঝাতে বসলেন এক চিজ তু মার্কিটমে ডাল, ক্যামপাইন লগা কি ইয়ে চিজ সবসে বঢিয়া হ্যায়। পৈসা লগা, পৈসা লগা, বড়া বড়া সব আদমিকো, মডিল জনানাকো সার্টিফিট হাসিল কর, বাস, সব আদমি তেরা বায়ার বন জায়গা। পলিসি তো ইয়ে হি হ্যায়? হ্যায় কি নেই?
জরুর।
জনানালোগ ইয়ে পিকচার দেখকে সব মার্লিন মানরো বনতে চাইবে। ঔর মরদ? উও ভি অ্যায়সিই আওরত চাইবে। তু এক কাম কর, নয়া নয়া কসমেটিক্স বনাতে চল। বহোৎসা অ্যাড লগা। কেমিস্ট লোগ সব কাম করতে করতে হায়রান হো জায়গা। তব তো নয়া লাইন মিলেগা!
পিতাজির এই উপদেশই যোগিন্দরকে তার নয়া সাম্রাজ্যের চাবিকাঠি জুগিয়ে দিয়েছিল। তার পর তিনি নয়া নয়া কেমিস্ট বহাল করেছেন, নয়া নয়া অ্যাড এজেন্সির টেন্ডার নিয়েছেন, বড় বড় মাল্টিপ্লেক্সে তাঁর ভি শপ খুলেছেন ইমপোর্টেড গুডস-এর শপের পাশে। এক দিনে এ সব হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে, দশ বছর ধরে হয়েছে। তাঁর কোম্পানির ফেয়ারনেস ক্রিম, স্লিমিং পিল, লম্বা হওয়ার পিল, হরেক রকম হেয়ার কালার, হেয়ারডাই, টাকে চুল গজানো, মেছেতা দূর করা, স্ট্রেচ মার্কস দূর করা, রিঙ্কলস দূর করা... কসমেটিক্স বেরিয়েই যাচ্ছে, বেরিয়েই যাচ্ছে, বছর বছর তাদের প্যাকেজিং পাল্টাচ্ছে। যত বার প্যাকেজ পাল্টাচ্ছে ততবার ভেতরের জিনিস কমে যাচ্ছে, কিন্তু সে শিশি কৌটোর এমন বাহার যে, ব্যবহারকারী তাকে প্রাণে ধরে ফেলে দিতেও পারে না। তারও আবার দাম আছে। সামান্য হলেও তো দাম! কোম্পানির কাছে বিক্রি করো, রিসাইকল হবে। একটা পরিবেশ সমস্যা সমাধানের কাজও হল, লাভও হল! বড় বড় ফিল্মস্টার, বড় বড় মডেলরা সব বলছে তারা ‘ডালিজ’ ছাড়া আর কোনও কসমেটিক্স ব্যবহার করে না, এখন তো তিনি মরদলোকের কসমেটিক্সও বানাচ্ছেন। তাঁর চিফ কেমিস্ট তাঁকে পার্ফুমে যেতে বলছে, আরও কিছু ওষুধপত্রের ব্যবসায় যেতে বলছে, উত্তেজক ওষুধ, কিন্তু তিনি সাহস করছেন না... যোগিন্দরের হাত সাফ, গন্ধা কামে তিনি চট করে হাত লাগান না।
আর সেই পিতাজি এখন নিজের বাৎলানো ধান্দার সমালোচনা করছেন? আবার করছেন এমন ভাবে যেন যোগিন্দরই সব কিছু করেছে, তিনি বিলকুল কিচ্ছুটি জানতেন না। একেবারে নিষ্পাপ শিশুটি!
হমারা ক্রিম সব বহোৎ বঢিয়া পিতাজি, বেস্ট কেমিস্টলোগো নে বনায়া। আপনার এ রকম মনে হচ্ছে কেন?
ডালমিয়া বললেন, আরে বুদ্ধু, তু আমাকে ক্যা শিখলাবি? কেমিকলসে আজ কুছু হোবে না, কাল কুছু হোবে না, তার পর? ও তো স্কিন বিলকুল ড্যামেজ করে দেবে রে? আর ও সব পৎলি হবার লম্বি হওয়ার চুল রং করার কসমেটিক্স বনাচ্ছিস ও ভি তো সিস্টম বিলকুল খারাব করে দেবে!
যোগিন্দরের মনে হল এই মহিন্দার ডালমিয়াই যে একদা তাকে বিউটি বিজনেসে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, এ সব কথা এখন মনে করিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই। এ বুডঢা এক দিকে মহা ধুরন্ধর আর এক দিকে বিলকুল বুডঢা যৈসা, সব ভুলে মেরে দিয়েছে। তাঁর কোম্পানির কোনও ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির কেমিস্টই বোধ হয় বাপুজির কান ভাঙিয়েছে। তিনি বললেন, কে এত সব খাস বাত বলে গেল আপনাকে?
শয়তানি হেসে সিনিয়র ডালমিয়া বললেন, এক ছোটিসি চিড়িয়া, এক চুড়ৈল। তার পর বললেন, মেরি বাত সুনা করো বেটা, আমরা তো জনম জনম বহোৎ পুণ কামিয়েছি, তো এ জনমমে ইৎনা পাপ কামালে সব বরবাদ হয়ে যাবে। এ কসমেটিক্স কি কারোবার বন্ধ করে দাও। লোহা, আয়রন অ্যান্ড স্টিল কি কাম করো। বাস!
বলে ডালমিয়া পিতা আরামচেয়ারে কাত হয়ে চক্ষু বুজলেন। মানে, তিনি আর ছেলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবেন না। বাত খতম।
এখন কী করেন যোগিন্দর? এ কসমেটিক্স বিজনেস এক আজিব চিজ। গ্লোবালাইজেশনের পরে ওয়েস্টার্ন দুনিয়া থেকে এসে গেল। তিনি যদি বন্ধ করেও দেন, অন্যে করবে, অনেকে করে চলবে। মেডিক্যাল স্যাংশন নেই, এমন চিজও বাজারে দিব্যি চলছে। কাগজে বড় বড় করে তার বিজ্ঞাপন হচ্ছে। আর তিনি কী-ই বা অন্যায় করছেন? যে সব চিজ তিনি ব্যবহার করেন, তার বেশির ভাগই হারবাল বলে রেজিস্টার্ড। লম্বা হওয়া? ও সব জিনের কাম। কেউ কাউকে করে দিতে পারে না। তাঁর চিফ কেমিস্ট, কনসালটিং ডাক্তার তাঁকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে। এখন, ওই ট্যাবলেটের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু উপদেশ থাকে, প্রোটিন খাওয়া, স্ট্রেচ ব্যায়াম করা, কী স্কিপিং করা, এ সবে কিছুটা বডি ফিট হবে, একুশ বছর বর্যন্ত তো সব ছেলেপিলেরই কিছুটা বাড় হয়, তাইতেই... স্লিমিংও তাই, ব্যায়াম করো, কষে হাঁটো, ফ্যাট শুগার কম খাও, কোনও হরমোনাল গোলমাল হয়ে থাকতে পারে, ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাও, ঠিক হয়ে যাবে। তবু এ জনানালোগ ট্যাবলেট খেয়ে আরাম পায়। অনেকটা কালীমায়িকে পূজা চঢ়ানোর মতো। ওই বিশ্বাসটাকে তিনি তৈরি করেছেন এই মাত্র। আর এই বডির দিকে চোখ ফেরানো? বডিই স্বর্গ, বডিই ধর্ম, বডি হি পরমং তপঃ এ কাল্ট তিনি তৈরি করেননি, করেছে গ্লোবাল বাজার। তিনি নিমিত্তমাত্র। হ্যাঁ, ব্লিচিং এজেন্ট বেশি পড়ে গেলে, বা দীর্ঘ দিন ব্যবহার করলে, যার সইছে না সে যদি ব্যবহার করেই যায়, করেই যায়, তা হলে ক্ষতি হতে পারে। তাতে তাঁর কতটুকু দায়? এমন লাভজনক ব্যবসাটা অমনি বন্ধ করে দিলেই হল?
কথাটা বাপুজিকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন তিনি। তখন বুডঢার নতুন আবদার হল বেশ, সিগারেটের পাকিটে বা বিজ্ঞাপনে যেমন থাকে, তেমনি ইউজ হার্মফুল লিখে দিতে হবে, আর নাঙ্গা মডিল বা যে মডিল ও প্রোডাক্ট ব্যবহার করেনি, তাকে কাজে লাগানোও চলবে না। এ কখনও হয়? তিনি পেরে উঠলেন না। বুডঢা তাঁকে উত্যক্ত করেই যেতে লাগলেন, করেই যেতে লাগলেন, না হলে নাকি তিনি নিজেই বিজ্ঞাপন দিয়ে ‘ডালিজ’-এর গোপন কথা বলে দেবেন।
সত্যনাশ!
তবে বুডঢা তো! মরণকাল যত এগিয়ে আসে ততই তাদের বুদ্ধিনাশ হয়। মহিন্দার ডালমিয়া খুব শিগ্গিরই প্রেশার চড়ে দুম করে মারা গেলেন। সে বছরই ডালমিয়া ঘরানার লছমিজির মার্বলের মন্দিরের ভিত পুজো হল নিউ টাউনে, প্রয়াত মহিন্দর ডালমিয়াজির নামে, বাইপাসে ‘ডালিজ’-এর এক বিশাল হোর্ডিংও উঠল, এক প্রায় নাঙ্গা আওরৎ, যার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সব খুবসুরৎ চিজই নাকি ‘ডালিজ কসমেটিক্স’ই বানিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় হইহই।
পিতাজির অ্যাডভাইসগুলো এখন প্রায়ই মনে পড়ে যোগিন্দরের। উমদা সব অ্যাডভাইস। এ যুগের বেওসা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এ হি আজকালকা কারোবার, এ বডিকা ফায়দা উঠা বেটা।
আর কামকাজ করতে অপারগ বুডঢাদের সম্পর্কে? বলেছিলেন, খতম কর দে বেটা, চুপচাপ খতম কর দে।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|