|
|
|
|
|
|
|
দিদি পক্ষ |
দেবী বলে দেখি না বলেই সে বোধ হয় মায়ের চেয়ে আরও কাছের।
এই মহালয়ায় সেই স্নেহ-ঈর্ষা-ভালবাসাদায়িনীর কথা। স্বাতী ভট্টাচার্য
|
ইতালির লোকে বলে, এ জগতটা এতই কঠিন জায়গা যে স্রেফ একটা বাবা দিয়ে ম্যানেজ হয় না। সেই সঙ্গে এক জন ‘গডফাদার’ দরকার। পরিবারের কোনও ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বা আত্মীয়, তাই ঈশ্বর সাক্ষী রেখে শিশুর দ্বিতীয় পিতা হয়ে যান।
বাঙালি বাবারা বাজারের ব্যাগটি ফেলে দিয়েই ডিউটি শেষ করেন, অগতির গতি হল মা। কিন্তু বাঘ, ভূত, পলিটিকস, ক্রাইম, কম্পিটিশনের এমন রমরমা যে বিপত্তারিণীর এক জন অ্যাসিস্টেন্ট দরকার হয়। সেই হল দিদি। সব ভাইয়ের গডমাদার। বাড়ির হলে রেডিমেড, পাড়ার হলে অর্ডারি।
সাইকেল রিকশার পিছনে অনেক সময়ে লেখা থাকে, ‘পাইলট পল্টু’। বাসের ড্রাইভারের দরজার পাশেও লেখা থাকে ‘পাইলট।’ মহাকরণের দরজায় কথাটা অদৃশ্য অক্ষরে লেখা থাকে। রাজ্যের পাইলট এখন দিদি। দিদি আসার পর থেকেই দিদিকে ‘মা’ বলে দেখার একটা হিড়িক শুরু হয়েছে। দিদির মুখ বসিয়ে দেবী মায়ের মুখ। মেয়েরা চেয়ার পেলেই দশভুজার আদলে চেলে দেওয়ার ঝোঁক কেন রে বাপু? ‘দিদি’ মডেলটা কম কীসে? মা দুর্গার ক’টাই বা রূপ। কোনও কোনও ক্লাব কায়দা করে নবদুর্গার ন’খানা মূর্তি করে, কিংবা দশমহাবিদ্যা। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবী স্বয়ং সম্ভাব্য যে সব রূপের কথা বলেছেন, যথা কুষ্মাণ্ডা, ঘণ্টা, শাকম্ভরী, সে সব মিলিয়েও সাতাশ-আঠাশের বেশি উঠবে না। দুর্গার আর এক নাম ‘শতরূপা’, তা ধরে নিলেও মায়ের স্কোর সেঞ্চুরি ছাড়ায় না। কিন্তু দিদি? মেয়েদের রূপের প্রায় পুরো রেঞ্জটা দিদিদের মধ্যে চলে আসে। মহাকাশচারী থেকে মাকড়শা-চেপটাকারী, ভয়ানক সাহসী দিদিরা আছে। আবার অঙ্কে-ভেবলানো, চোরাই আচার ভাগ-করে-খাওয়া ভীতু দিদিরাও আছে। পাড়ার দিদি হলে তো কথাই নেই, আধা-রোম্যান্স থেকে পরম পূজনীয়া, যে কোনও খাপে ভরে ফেলা যায়।
দিদিদের সঙ্গে মায়েদের তুলনা চলে না। মায়েরা আম গাছে ঢিল ছুড়তে পারে না, মোবাইলে আসা প্রেমের মেসেজ দেখিয়ে হি হি করে হাসতে পারে না, ক্লাস |
‘পথের পাঁচালী’: দুর্গা |
কেটে সিনেমা দেখায় দীক্ষা দিতে পারে না। বয়ঃসন্ধি সাঁতরে প্রাণ নিয়ে বাঁচার কোনও টিপস মায়েদের কাছে পাওয়া যায় না দিদিরাই সে সব দিতে পারে। স্কুলে ফেল করলে বাড়িতে প্রোটেকশন দেওয়া, সে-ও দিদিদের স্পেশাল অপারেশন। আবার বিনা দোষে নালিশ করে মার খাওয়াতেও দিদিরা ওস্তাদ। দিদিরা স্নেহের সঙ্গে হিংসের, সহযোগিতার সঙ্গে প্রতিযোগিতার এমন পাঞ্চ করতে পারে, যে সম্পর্কটা একদম তেঁতুল-নুন-লঙ্কা-চিনির মিক্সচার হয়ে ওঠে। তাই রণে-বনে-জঙ্গলে দিদির মোবাইল নম্বরটি রাখা ভাল। তাতে ভয় না কাটতে পারে, অন্তত বোর হতে হবে না। ‘ইডিয়ট, তোকে কতবার বারণ করেছি, ফের তুই ...’ ইত্যাদি কলরবে বিপদ কোনও এক ফাঁকে কেটে যাবে। |
|
‘মেরে পাস মা হ্যায়,’ ডায়লগ ঝাড়লে আজ আর চিঁড়ে ভেজার চান্স নেই দিদি পাশে আছে কি নেই, ঝেড়ে কাশো দেখি বাপু। আজ দিদির চপ্পলই ক্ষমতার উৎস। বরাবর দেবীপক্ষ নিয়ে নাচানাচি হয়।
এ বার একটু সাবঅলটার্ন হয়ে দিদিতে এলে ক্ষতি কী? দেখাই তো গেল, হাতজোড় করে ‘মা মা’ ডেকে খুব বেশি কিছু বদলায় না, পরিবর্তন করতে পারে দিদিরাই। দিদি কারও মা নয়, হ্যা। অসুরের কাছে ঝাড় খেয়ে কেঁদে পড়লে মায়ের কাছে, আর মা অমনি গিয়ে সাংঘাতিক যুদ্ধ করে শত্তুর বধ-টধ করে দিয়ে আবার আঁচলটি জড়িয়ে বড়ি-চচ্চড়ি রাঁধতে লাগল। এই সব ফিউডাল, কলোনিয়াল মডেল ভেঙেছে দিদিরা। গায়ের জোরে জেতা জিনিস ছাড়তে যাবে কেন মেয়েরা, অ্যাঁ? পাওয়ার ইজ নট আ ফ্রি গিফট। বছরে চারটি দিন খাতির করে তার পর নাচতে নাচতে বিসর্জন দিয়ে আসবে, সে দিন আর নেই ভাইটি। এ বছর দেবীপক্ষ সেলিব্রেট করতে চাও করো, কিন্তু মনে রেখো আসলে এ হল দিদিপক্ষ।
কিন্তু কাগজকুড়ুনি থেকে কর্পোরেটকর্ত্রী, ‘দিদি’ বললে কেউ অফেন্স নেবেন না। আপনার বয়স যা-ই হোক, ষোলো থেকে ছেষট্টি যে কোনও বয়সের মেয়েকে দিদি বলে ডাকতে পারেন। আমাদের ঘরে-বাইরে যারা আঁচল-ওড়না সামলে প্রাণপণে প্যাডেল করে জীবনটাকে চালাচ্ছে, তাদের সবার এক পরিচয়। দিদি। |
ট্রামে-বাসে, ইস্কুলে-অফিসে যে মেয়েরা অতি-দ্রুত হাতের কাজ গুছিয়ে, বকাঝকার সঙ্গে আবদার-আদর মিশিয়ে কাজ উদ্ধার করে, তার পরেও সমাজের পাঁচ জনের মাঝখানে নিজের জায়গাটি তৈরি করে নেয়, সেই সব দিদিদের দিন এটা। ‘দিদি’ মানুষটিকে দেবতাদের মিলিত জ্যোতি তৈরি করেনি, বহু শতাব্দীর ট্র্যাডিশন তাঁর জন্য সোনার সিংহাসন তৈরি করে রাখেনি। ‘দিদি’ ডাকের পথচলতি শিষ্টতা ছাড়া আর কোনও প্রাপ্য বাঁধা নেই তাঁর জন্য। তাঁর জন্য কেউ জায়গা ছাড়তে নারাজ, ন্যায্য পাওনাটুকুও কখনও চেঁচামেচি করে, কখনও মাথায় হাত বুলিয়ে আদায় করতে হয় তাঁকে। |
‘মেঘে ঢাকা তারা’: নীতা |
|
‘বউদি’ ডাকে সংসার-সুখের সর-মাখা নিরাপত্তা আছে, ‘বোনটি’ ডাকলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, অপরিচিত পুরুষের মুখে ‘মা’ ডাকে প্রায়ই সম্মানের আড়ালে তাচ্ছিল্যের সুর শোনা যায়। ‘ম্যাডাম’ একটু এলিটিস্ট সম্বোধন, বাড়ির কাজের মেয়েটিকে ঠিক ‘ম্যাডাম’ বলে ডাকা যায় না।
যদি গোটা দেশটার দিকে তাকান, তা হলে খেয়াল করবেন যে ছোট বোনেরা সংখ্যায় কমে যাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে দিদিরা। মানেটা সহজ আজকাল ‘ডিজাইনার’ পরিবার হচ্ছে ঘরে ঘরে। সেই ডিজাইন হল একটি ছেলে, একটি মেয়ে। অতএব প্রথমটি যদি মেয়ে হয়, পরেরটি মেয়ে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় অনেকখানি নানা বৈজ্ঞানিক প্রকরণে সন্তান যেন ছেলেই হয়, তা নিশ্চিত করছেন বাপ-মা। শহুরে উচ্চবিত্ত থেকে গ্রামের মধ্যবিত্তে ছড়িয়ে যাচ্ছে এই ধারা। ছেলে হলে একটি সন্তানে থেমে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
মেয়ে যদি রাখা হয়, তাকে দিদি করেই রাখা হবে। তাতে যে দিদিদের খুব সুবিধে হবে, এমন নয়। ধনী বাপ তাকে গয়না দেবে, ভূ-সম্পত্তির ভাগ দেবে না। গরিব বাপ ভাই-বোনকে ধরার জন্য তাকে স্কুল ছাড়িয়ে দেবে। ছেলেবেলা থেকে দিদি ভাইকে না দিয়ে খেলে দুঃখ পাবে, উপোস করে রাখি বাঁধবে, ভাইফোঁটা দেবে। বড় হয়ে দেখবে, ভাইয়ের আসন, সুখাদ্যের থালার ব্যবস্থা গোটা সমাজ-সংসার করে রেখেছে। দিদির নিজের আসন কোথায় পড়বে, কী-ই বা পড়বে পাতে, তা বড় অনিশ্চিত। আজ যিনি মহাকরণের চেয়ারে আসীন, সেই দিদিকেও একবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পার্টির অফিসে রাত কাটাতে হয়েছিল।
তা হোক, এমন অনেক বিপত্তি কাটিয়ে অনেক দিদি জীবনে নিজে দাঁড়িয়েছে, চার পাশের মানুষদের দাঁড় করিয়েছে। তারা অনেকেই নিতান্ত সামান্য মেয়ে, কিন্তু তাদের ধৈর্য, সাহস অসামান্য। তাদের মুখ দেখে তাদের জীবনের বুক-মোচড়ানো কষ্টগুলো আন্দাজও করা যায় না।
দিদিরা বাঙালি জীবনের কতটা বিস্তার জুড়ে রয়েছেন, সে কথাটা একটু নেড়েচেড়ে দেখার জন্য ‘দিদি’র ক’খানা মডেল আর একবার দেখা যাক। আরও অনেক, অনেক রকম দিদি হয় অবশ্যই। এ ক’জনের কথা বলা কেবল মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য, দিদিরা কত রূপে জুড়ে বসে রয়েছে জীবনে। কখনও পিত্তি চটিয়ে, কখনও হাত বুলিয়ে, খাড়া রাখছে আমাদের।
|
গাইড নাম্বার ওয়ান |
|
‘মেজদিদি’ |
দাদারা চট করে ছোট ভাইবোনকে সঙ্গে নিতে চায় না, তাদের সব অ্যাডভেঞ্চার বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু দিদিদের সঙ্গে হয় মায়েরা ভিড়িয়ে দেয় ছোটদের, নইলে দিদিরা নিজেরাই জগত আবিষ্কারের আনন্দটা ভাগ করে নিতে চায় হাত-ধরা ভাই-বোনের সঙ্গে। সে দিক থেকে দিদি নাম্বার ওয়ান নিঃসন্দেহে ‘পথের পাঁচালী’র দুর্গা। অপুর জীবনে অনেকখানি জুড়ে যে তার দিদি রয়েছে, তা এই জন্য যে অপুর চোখের সামনে থেকে একের পর এক পর্দা সরিয়ে দুর্গা গ্রামের জগতখানা যেন তুলে ধরেছে। এমন ভাবে বাইরের পৃথিবীটার সঙ্গে পরিচয় দিদির হাত ধরে হয়েছে অনেকেরই। যত আশ্চর্য জিনিসে দুনিয়াটা ঠাসা, যত অদ্ভুত সব কাজ-কারবার চলে, যত বিচিত্র লেনদেন, তার বেশির ভাগটাই ছোটদের জন্য নিষিদ্ধ। ‘বড় রাস্তায় যাবে না,’ ‘অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলবে না’ ‘বাইরের খাবার খাবে না’ গোছের নিষেধগুলো ভাঙতে না পারলে বড় হওয়ার পালাটাই শুরু হয় না। দিদির হাত ধরে যাদের সেই পালা শুরু, তাদের জন্য সেই চলাটা ছাতা-মাথায় হাঁটার মতো। অনেকটা ঝড়ঝাপটা দিদিরাই সামলে নেয়।
|
টু-ইন-ওয়ান |
এর সেরা উদাহরণ অবশ্যই শরৎচন্দ্রের মেজদিদি। এরা এক দিকে মূর্তিমতী করুণা, অন্যদিকে এঁটেল মাটির মতো শক্ত। প্রচুর আদরযত্ন এদের ইউ এস পি। মনে করুন মেজদিদির কেষ্টর জন্য গরম দুধের বাটি হাতে রান্নাঘরে যাওয়া। ছোট ভাই গোছের যে কোনও লোককে পেলে এরা পেটটি না ঠেসে দিয়ে ছাড়েন না। তবে মেজদি এত হিট এই কারণে যে তিনি কেবল গ্যাদগ্যাদে সেন্টিমেন্ট-এর কারবারি নন, নিজের স্বামী-শ্বশুরবাড়ির অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস তাঁর ছিল। আজও চার পাশে তাকালে এমন মেয়ে পাওয়া ভার যে অপরের জমি-সম্পত্তি অন্যায় ভাবে অধিকার করার প্রতিবাদে নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে যেতে পারেন, এমনকী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন। এমন দু’একটি দিদিকে আমরা সবাই চিনি তাঁরা বাইরে ‘ও মা, তাই নাকি, কী কাণ্ড’ করে চালিয়ে যান, যেখানে দরকার মাথা নাড়েন। কিন্তু যেখানে তাঁর হাতটি মাথায় না রাখলে কারও ক্ষতি হয়ে যাবে, সেখানে বকে-ধমকেও তাঁর ঘাড় নত করা যায় না।
|
কথা বলে কে? |
এই বলে একটা হাঁক দিয়ে বুকের রক্ত মিক্সড ফ্রুট জ্যাম করে দিতে পারে, প্রতি ইস্কুলে এই গোত্রের দুয়েকটি দিদি থাকেনই। তাঁদের কল্যাণে পয়ঁতাল্লিশ পেরিয়েও কে জি ওয়ান-এর ক্লাসরুমের কথা ভেবে কলজেটা হাঁটুতে নেমে আসতে চায়। এমন দিদিরা কোনও কোনও পাড়াতেও থাকেন।
‘দাদার কীর্তি’ ছবিটা মনে আছে নিশ্চয়ই, মহুয়া মুখোপাধ্যায় ‘সরস্বতী’ চরিত্রটিকে বাঙালির মনের দেওয়ালে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে দিয়েছেন। কেবল নিজের বোন নয়, গোটা পাড়ার ছেলেরা সরস্বতীর শাসনে তটস্থ ছিল। বাড়িতে এমন একটি স্যাম্পেল থাকলে জীবন গ্যামাক্সিন। ‘যেখানে যেটা সেখানে সেটা, যখন যেটা তখন সেটা’ এমন মারাত্মক ডিসিপ্লিনে এই দিদিরা বাড়ির ছোটদের একেবারে বেঁধে ফেলে। বাবা-মায়েরও এই সব দিদিদের উপরে কথা বলার সাধ্যি থাকে না। ফিউচার ভাগ্নে-ভাগ্নীর দুর্দশার কল্পনা ছাড়া সান্ত্বনার কোনও উপায় নেই।
|
ক্লাসে ফার্স্ট |
|
‘দাদার কীর্তি’: ছোট বোন বিনি আর দিদি সরস্বতী |
এরা খুব ডেঞ্জারাস। গোড়াতেই মগডালে চড়ে বসে, ফলে আর কিছুতেই কারও মন ওঠে না। এমনকী ফার্স্ট হতেও ইচ্ছে করে না ‘ও, তুইও পারিস তা হলে’ শোনার জন্য কে রোজ পঁচিশটা অঙ্ক করবে? ‘ছায়াসূর্য’ ছবিটাতে শর্মিলা সেজেছিলেন ছোট বোন ঘেঁটু, দিদি ‘মল্লিকা’ চরিত্রটা এমনই ছিল সুন্দরী, সুগায়িকা, ক্লাসে প্রথম একেবারে ‘ভাল মেয়ে’-র এপিটোম। ঘেঁটুর উলুঝুলু চুল, তবলা বাজানো, খ্যাপা ষাঁড় আঁকা, ক্লাসে ফেল করা, এ সব অনেকটাই দিদির ভালত্বের প্রতিক্রিয়ায়।
এমন আর একটি ছবি ছিল ‘সাজ’ মুম্বই লতা-আশার প্রতিযোগিতার প্রতিচ্ছবি বলেই ধরা হয়েছিল সে ছবিটাকে। নিজে অসামান্য প্রতিভাময়ী হয়েও ছোট বোনকে উঠতে না দেওয়ার জন্য বড় বোনের চেষ্টা, তার গানের অংশ নিজে আগ বাড়িয়ে গেয়ে দেওয়া এ সবই এগিয়ে থাকার দাবিতে। মমতাময়ী ইমেজে এই দিদিরা ঠিক ফিট করে না। ছোট ভাই-বোনেরা বাইরে এদের উপেক্ষা করে, ভিতরে প্রায়ই প্রশংসার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে।
|
যারা শুধু দিয়ে গেল |
এই দিদিরা নীরবে আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত হয়ে গিয়ে সারা জীবন বিবেকযন্ত্রণায় ভোগায়। এদের মধ্যে এক নম্বরে অবশ্যই ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবির নীতা। যদিও তার মুখের যে কথাটি সকলে মনে রেখেছে, সেটা ছোট বোনের সংলাপ ‘দাদা, আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম,’ কিন্তু সংসারে যে ভূমিকাটি সে নিজের জন্য নিয়ে রেখেছিল, সেটা দিদির। এমন দিদি যে ভাই-বোনদের আগে রেখে নিজেকে রেখেছে পিছনে। মধ্যবিত্ত জীবনে যখন রোজগারের এত খুচরো-পাইকারি উপায় খুলে যায়নি, রাজনীতি করতে হত জীবনপণ করে, তখন বহু মেয়ে সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিয়েছে। টেলিফোন অফিসের দিদি, হাসপাতালের নার্স দিদি, সরকারি দফতরের দিদি, ইস্কুলের সেলাই দিদিমণিরা কখন যেন পিসি, পিসশাশুড়ি হয়ে গিয়েছে, মা হতে পারেনি। প্রায়ই ভাইবোনেরা তার মূল্য দেয় না ‘যদুবংশ’ ছবির অপর্ণা-অভিনীত দিদির কথা মনে করুন, কিংবা ‘ফিফটিন পার্ক অ্যাভিনিউয়ের’ শাবানা। এই দিদিরা কালো ছাতা হাতে হেঁটে চলে যায়, জীবনটাই যেন বিবর্ণ করে দিয়ে যায়। সংসার স্বার্থপর, তুই কেন ভুলে গেলি দিদি?
|
শ্রীমতী ভয়ংকরী |
এদের উলটো দিকে রয়েছে ছিন্নমস্তা মডেল ভাই বা বোনের ক্ষতি করে নিজের পুষ্টি সাধন করতে চান এরা। যৌন ঈর্ষা এসে গেলে ব্যাপারটা আরও গোলমেলে হয়ে যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সরীসৃপ’ গল্পের দিদি, যেখানে বিধবা ছোট বোন স্বামীকে আকর্ষণ করছে দেখে বড় দিদি তাকে কুষ্ঠরোগীর উচ্ছিষ্ট খাইয়ে মারতে চেয়েছিল। এত তীব্র, তিক্ত ঘৃণার নিদর্শন বোধ হয় বিশ্বসাহিত্যে কমই রয়েছে। রূপকথায় প্রায় সব সম্পর্ককেই কয়েক পোঁচ রং চড়িয়ে দেখানো হয়। সেখানে খারাপ মহিলারা প্রায় সকলেই হয় সৎ মা, সতীন, সৎ ভাই বোন, নইলে রাক্ষসী বা ডাইনিবুড়ি। দিদিদের দেখাই মিলেছে কম, ছোট বোনেরা তবু খানিকটা জায়গা পেয়েছে। আসলে মাত্র গোটাকতক গল্প ছাড়া রূপকথার মেয়েদের উদ্ধার করেছে পুরুষরা। সেখানে একলা রাজকুমারী বা হারানো ছোট বোনকে উদ্ধার করা সহজ। বীরত্ব দেখিয়ে দিদিদের ইমপ্রেস করা বেশ কঠিন, চোখ পাকিয়ে হয়তো বলে বসবে, ‘ফের বাবার পক্ষীরাজটা নিয়ে এসেছিস, তোর টাট্টু কী হল?’
|
হৃদমাঝারে রাখিব |
‘দ্য কালার পার্পল’: সিলি |
ঝকঝকে এক খণ্ড হিরের যেমন কোনও তুলনা হয় না, তেমনই সেই দিদিরা যাঁরা ছোট ভাইবোনকে রেখেছেন জীবনের মধ্যিখানে। যাঁদের জীবন অর্থ পায় সহোদরকে ঘিরে। অ্যালিস ওয়াকারের ‘দ্য কালার পার্পল’ যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা ভুলতে পারবেন না ‘সিলি’ নামের সেই কৃষ্ণাঙ্গ, কুরূপা মেয়েটির কথা, যে নিজের সৎ বাবার কাছে বারবার ধর্ষিত হয়েও নিজের বোনটির জন্য বাঁচতে চাইত, বোনকে বাঁচাতে চাইত। বোন পালিয়ে যাওয়ার পর গোটা জীবনটা সিলি ভগবানকে চিঠি লিখে গিয়েছে। বোনও চিঠি লিখেছে সিলিকে, কিন্তু সিলির স্বামী তা লুকিয়ে রেখে দিত, দিত না তাকে। শেষ অবধি সিলির সন্ধান পেয়ে ফিরে এল ছোট বোন, সেই সিলির নতুন জীবনের শুরু। |
|
এ গল্পে ছোট বোনটি দিদির অবলম্বন। আমরা একই মায়ের শরীর থেকে জন্মেছি, এই বন্ধনের জোর শ্বেতাঙ্গদের, পুরুষদের, অপরিসীম তাচ্ছিল্য-নির্যাতনকে রুখে দিতে পেরেছিল।
আমাদের গ্রাম বাংলায় যে বধূটি মাঝিকে ডেকে গান গেয়েছিল, ‘বছরখানি ঘুইরা গেল রে, ভাইয়ের দেখা পাইলাম না, কইলজা আমার পুইড়া গেল রে, ভাইয়ের দেখা পাইলাম না,’ আন্দাজ করা যায় শ্বশুরবাড়ির অনাদরের সব দুঃখ সে ভাইয়ের মুখটি দেখে ভুলতে চেয়েছিল। এই দিদিরা জীবনের খানাখন্দ ভরে দেয় মধুময় অশ্রুতে।
এমন সব দিদিরা প্রায় সকলেই নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, আলাদা করে নজর না করলে এরা ধরাই পড়ে না। এরা অনেকেই কারও আদরের পুত্তলি নয়, কারও স্বপ্নের রানি নয়, নেহাত আটপৌরে, সংসারে-দফতরে ডুবে থাকা দিদি।
কিন্তু বিয়ে-বউভাতেই হোক, সেমিনারে-সম্মেলনে আর রাজনীতিতে, এরা পাশে গিয়ে না দাঁড়ালে কোনও কিছু ঘটে ওঠে না। গ্রামের স্বনির্ভর দলের দিদি হোক, আর চেম্বার অব কর্মাসের দিদি, তাঁর নুন-হলুদ মাখা, তর্জনীতে কালি-লাগা হাতের ছোঁয়া না পেলে কোনও প্রকল্প গতি পায় না। কোনও একটা গাঁটে এসে ঠেকে যায় কাজ, যখন দ্রুত মোবাইলের বোতাম টিপে বলতে হয়, ‘দিদি, আপনি আসছেন তো?’ |
|
|
|
|
|