|
|
|
|
নিরামিষ নট আউট |
তরিতরকারির প্রতিটি বডি-পার্টসের এমন অসাধারণ সদ্ব্যবহার বাঙালি ছাড়া
বোধ হয় আর কারও জানা নেই। শ্রাবণী রায় আকিলা |
বাঙালি মানেই চূড়ান্ত খাদ্য রসিক সেটা সকলেই জানেন। কিন্তু দুঃখের কথা এই যে, অন্যান্য প্রদেশের লোকেরা বাঙালি মানেই একটা আঁশটে গন্ধওয়ালা প্রাণীবিশেষ মনে করেন। তাঁদের ধারণা আমরা মাছ ছাড়া আর বিশেষ কিছু রাঁধতে বা খেতে জানি না। অথচ, নিরামিষ রান্নার সম্ভার ও বৈচিত্রে আমাদের জুড়ি নেই।
শুক্তো, ঘণ্ট, এঁচোড়, ধোকা, পোস্ত এ সব তো স্বমহিমায় আছেই। তা বাদেও যে কোনও তরিতরকারির প্রতিটি বডি-পার্টসের এমন অসাধারণ সদ্ব্যবহার বাঙালি ছাড়া আর বোধ হয় আর কারও জানা নেই। বিচি, খোসা, ডাঁটার নিপুণ রিসাইক্লড রন্ধনশৈলীতেও আমরা শ্রেষ্ঠ। কচুর ডাঁটা, ওলের ডাঁটা, কাঁচকলার খোসা, কাঁঠালের বিচি, মোচার একেবারে ভিতর থেকে ট্রেজার হান্টের মতো তার ফুল বার করে এনে পাতুরি রান্না এ সব নিরামিষ রান্নার আবিষ্কারক তো মাছখেকো বাঙালির হাতেই।
অন্য বাচ্চারা যে বয়সে মাছ বা ডিম ছাড়া খেতে চায় না, সে বয়সেই আমি মাকে থোড়ঘণ্ট খাওয়ার জন্য জ্বালিয়ে খেতাম। মা আবার হেন কোনও খিটকেলে নিরামিষ রান্নাই বাদ দিতেন না। বাবা বরাবরই সময় পেলে মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করতেন। ছুরি দিয়ে সবজি কেটে দিতেন, তা প্রায়ই মাকে দেখতাম “রে রে” করে বাবার পিছনে তেড়ে যাচ্ছেন, কী না বাবা লাউ বা কাঁচকলার অমূল্য খোসা অবলীলায় ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন। আহা, তার কোনওটাকে সেদ্ধ করে, কাঁচা লঙ্কা কালো জিরে দিয়ে, কোনওটাকে আবার সর্ষেবাটা দিয়ে ঝাল করে মা সেগুলোকে খাবারপাতে অমৃত রূপে পরিবেশন করতেন। যারা কুমড়ো ফুল ভাজা, চালকুমড়োর খোসা চালবাটা দিয়ে ভাজা এ জীবনে খেল না, তারা কোথায় কী করতে জন্মাল কে জানে! |
|
এই সব বিচি, খোসা, শাক, ডাঁটা নিয়ে লিখতে বসলে আমার মামাতো দাদা মানে পার্থদাদার কথা না লিখলে সব তরকারির সব খোসা, বিচি বা পার্থদাদা কোনও একটার প্রতি অবিচার করা হবে। পার্থদাদা ছোটবেলা থেকেই রাঁধতে ভালবাসে। মাধ্যমিক পরীক্ষার আগের দিনও চুপিচুপি পুঁইশাক রাঁধতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। তার মতো অত হাজারো ভজকট নিরামিষ রান্নার হদিশ আর কেউ দিতে পারবে না। কিছু রান্না হয়তো গত একশো বছর আগে কেউ শেষ রেঁধেছে, আর সে সব রান্নার জন্য সে কিছু খাটতেও পারে। মনে আছে, ছোটবেলায় গরমের ছুটিতে নিয়মমাফিক মামারবাড়িতে গিয়েছি, হঠাৎ এক দিন সকালে দেখি সব মামারা চেঁচাতে চেঁচাতে পার্থদাদাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে আসছে। তার সর্বাঙ্গ দড়ি দিয়ে বাঁধা, অথচ ডান হাতে ঠিক স্ট্যাচু অব লিবার্টির টর্চের মতো ক’গাছা কচুশাক ধরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বাগানের পরিত্যক্ত কোনায় ওগুলো খুঁজতে গিয়ে সাপে কেটেছে। সাপ বিষাক্ত না হওয়ায় সে যাত্রায় সে বেঁচে যায়। যদিও তার উৎসাহে কোনও দিন ভাঁটা পড়েনি। এখনও সে পাটপাতা, খারকোশ পাতা, কুমড়ো ফুল এ সবের খোঁজে তিনটে বাগানের আনাচেকানাচে মরে শান্তি না পাওয়া অশরীরী আত্মার মতো ঘুরে বেড়ায়।
নিরামিষের কথা বলতে গেলে, মোচার কথা বলতেই হবে। কিছু কিছু ফিল্মের অভিনেত্রী থাকে দেখতে তেমন সুন্দরী নয় কিন্তু দারুণ স্ক্রিন প্রেজেন্স। পর্দায় সে এলে বাকিরা আর চোখেই পড়ে না। মোচা হচ্ছে ঠিক সে রকম। মোচা ছাড়া আমার বাঁচার আশা বরাবরই খুব ক্ষীণ ছিল। বিয়ের পরে বিদেশে এসেই অন্যদের থেকে জেনে চাইনিজ সুপার মার্কেটে গিয়ে চোখ ঢ্যালা ঢ্যালা করে ‘বানানা ব্লজম’ লেখা টিন খুঁজতে শুরু করেছিলাম। এখন অবশ্য আস্ত মোচাও মাঝেমাঝে পাই। আর তা পেলে ছোটবেলায় পুজোর সময় কেনা নতুন জুতোর মতো মাথার পাশে রেখে শুতে ইচ্ছা করে।
|
|
আমেরিকায় সব সময় দেখেছি বাঙালিরা তাদের উইকএন্ড পার্টিগুলোতে আমিষের সঙ্গে সঙ্গে নানা রকম নিরামিষ পদ রান্না করে সবাইকে তাক লাগান। বাড়ির সঙ্গে বড় ব্যাকইয়ার্ড থাকলেই তারা লাগিয়ে ফেলেন সজনে, ঝিঙে, লাউ, কুমড়ো, পুঁই শাক ইত্যাদি। বছর চারেক আগে এক বার শিকাগোতে আমার দিদির বাড়ির পিছনে অনেক কুমড়ো শাক হয়েছিল। আমরাও বেড়াতে গিয়ে তখন সেখানে ছিলাম। এক দিন দিদির বাড়ি পরিষ্কার করতে আসা পোলিশ মেয়েটি দিদিকে বলল আমার বাড়ির সব গাছ হরিণ না খরগোশে খেয়ে গেছে। তোমারও তো দেখছি ব্যাকইয়ার্ডের গাছগুলো নেই। কীসে খেল? দিদির সংক্ষিপ্ত গম্ভীর উত্তর, “আমরা”। রাতারাতি অত কুমড়ো ফুল, শাক যে কেউ অমন নিপুণ ভাবে কেটে রেঁধে খেয়ে চিহ্ন পর্যন্ত রাখে না, তা জেনে সে মেয়ে ইসাবেলা তো ভ্যাবাচ্যাকা।
বাঙালিদের এত্তসব কেরামতির রান্নার কথা অবাঙালিরা আদৌ জানেন না। তাই দেখা হলেই তাদের সেই এক বুলি, “আপসে কোই ফিশ কারি অউর রসগুল্লে কা রেসিপি লেনা হ্যায়।” এর পর এ রকম প্রশ্ন কেউ করলে আমি তাকে আলুর খোসা সেদ্ধ করে বেটে কালো জিরে, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রান্না করে আর তা জীবনে অন্তত এক বার খেয়ে কী করে সার্থক করতে হয়, তার পথ বাতলে দেব। |
|
|
|
|
|