|
|
|
|
টোল আদায়ে বাধা, অভিযুক্ত তৃণমূল |
পীযূষ নন্দী • গোঘাট |
তৃণমূলের ‘দৌরাত্ম্যে’ টোল ট্যাক্স আদায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন দলেরই কর্মী এক ঠিকাদার। ঠিকাদারকে দিয়ে টোল আদায় করা যাবেই না বলে ‘ফতোয়া’ দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। ফলে, পঞ্চায়েত সমিতির আয়েও কোপ পড়ছে। ঘটনাটি গোঘাট ১ ব্লকের ভাদুর পঞ্চায়েত এলাকার। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা মেটাতে শুক্রবার ব্লক প্রশাসনের কর্তারা উদ্যোগী হন। যদিও এ দিনই বিকেলে ঠিকাদারের চার জন কর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। ফলে, অচলাবস্থা এখনই কাটবে কিনা, তা নিয়ে প্রশাসনিক মহলেও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সিপিএমের দাবি, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এই পরিস্থিতি। যদিও সে কথা মানতে চাননি তৃণমূল নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, গ্রামবাসীদের বাধায় টোল আদায় বন্ধ করতে হয়েছে। এর পিছনে তাঁদের দলের কারও কোনও ভূমিকা নেই।
ভাদুর পঞ্চায়েতের যে রাস্তায় টোল আদায় করা হচ্ছিল, সেটি গোবিন্দপুর এবং কুলকি গ্রামের মাঝামাঝি একটি চৌমাথা থেকে উত্তর দিকে গোপালগঞ্জ, বাঘারপাড় প্রভৃতি গ্রামের দিকে গিয়েছে। মূল রাস্তাটি প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার আওতায় হলেও অন্তত ১২টি গ্রামীণ রাস্তা ওই সড়কের বিভিন্ন প্রান্তে সংযুক্ত হয়েছে। ইটভাটা এবং বালি খাদানগুলি ওই সব গ্রামীণ রাস্তার ধারেই পড়ে। বালি-ইট নিয়ে প্রচুর ভারি গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। গত কুড়ি বছর ধরে ওই গাড়িগুলির কাছ থেকে টোল ট্যাক্স আদায় করা হয়। যার দায়িত্বে ছিল স্থানীয় ভাদুর পঞ্চায়েত।
টোল ট্যাক্স বাবদ সংগৃহীত টাকার হিসেব নিয়ে নানা সময়ে এর আগে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। সিপিএম নেতারা ওই টাকা আত্মসাৎ করছেন বলে তৃণমূলের দাবি ছিল। ফলে, ওই টাকা গ্রামের উন্নতিতে কাজে লাগেনি। অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের প্রধান সিপিএমের মনসা মুদি। যদিও ব্লক প্রশাসনের কর্তাদের বক্তব্য, টাকার হিসেব ঠিকঠাক রাখা হত না। বিধানসভা ভোটের পর থেকে কোনও টোল আদায় করা হয়নি। ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’কেই যার কারণ বলে উল্লেখ করেন প্রধান।
চলতি মাসের গোড়ার দিকে গোঘাট ১ পঞ্চায়েত সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে পঞ্চায়েত সমিতি ওই রাস্তায় টোল আদায় করবে। তবে, সরাসরি নয়। দায়িত্ব দেওয়া হবে ঠিকাদারকে। সংগৃহীত টাকা ভাদুর পঞ্চায়েত এলাকার উন্নয়নে ব্যবহার হবে। সেই মতো টেন্ডার ডাকা হয়। বরাত পান মৃণালকান্তি আলু নামে স্থানীয় এক তৃণমূল কর্মী। তিনি এক বছরের টোল-বাবদ ৪ লক্ষ ৭০০ টাকা পঞ্চায়েত সমিতির কাছে জমা দেবেন বলে ঠিক হয়। সেই মতো, অগ্রিম ২ লক্ষ ৭০০ টাকা জমাও দেন। প্রশাসন সূত্রের খবর, দৈনিক টোল বাবদ ওই এলাকা থেকে আয় প্রায় ৪ হাজার টাকা।
শুক্রবার থেকে টোল আদায় শুরু করার কথা ছিল মৃণালকান্তিবাবুর। তাঁর অভিযোগ, স্থানীয় তৃণমূল নেতা শান্তিনাথ রায়ের নেতৃত্বে প্রায় আড়াইশো গ্রামবাসী এ দিন জড়ো হন। তাঁরা টোল আদায়ের কাজে নিযুক্ত কর্মীদের বাধা দেন। মৃণালবাবু-সহ ওই কর্মীরা ভয়ে পালিয়ে আসেন। ওই ঠিকাদারের কথায়, “গিয়ে দেখি প্রচুর লোক তৃণমূলের নামে স্লোগান দিচ্ছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, দলের সক্রিয় কর্মী হিসাবে আমি বরাত পাওয়ায় দলের লোকজন খুশি। একটু পরে দেখি, তারা মারমুখী হয়ে উঠেছে। অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে। তৃণমূলের বাধাতেই কাজ শুরু করা গেল না। কবে জটিলতা কাটবে, আদৌ কাটবে কিনা, কিছুই বুঝতে পারছি না।” মৃণালকান্তিবাবু সমস্যার কথা জানান দলের প্রভাবশালী নেতা তথা তৃণমূলের নবগঠিত স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক শান্তিনাথ রায়কে। ওই ঠিকাদারের কথায়, “শান্তিনাথবাবু এলাকায় এসে জানিয়ে দেন, এটা গ্রামবাসীদের ব্যাপার। তারা যা চাইবে, তাই হবে।”
কেন বাধা দিলেন ‘গ্রামবাসীরা’? শান্তিনাথবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এটা তৃণমূলের বাধা বা আন্দোলন নয়। মানুষ চাইছেন না, দরিদ্র্য এলাকায় কোনও রকম টোল আদায় করা হোক। তা ছাড়া, ওই পঞ্চায়েত এলাকার মানুষের দাবি, যদি নিতান্ত টোল আদায় করতেই হয়, তা হলে তা আগের মতোই ভাদুর পঞ্চায়েত করবে।” রবিবার বিডিওর সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।
আন্দোলনকারীদের তরফে বলরাম সিংহরায়, শেখ কাজির বাদশা নামে স্থানীয় দুই তৃণমূল নেতা বলেন, “টোল ট্যাক্স আদায় করতে হলে তা পঞ্চায়েতই করবে।” বলরামবাবুর যুক্তি, “অঞ্চলের সমস্ত গ্রামগুলি অনুন্নত। তফসিলি ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। অধিকাংশ রাস্তা মাটি-মোরামের। অল্প বৃষ্টিতেই যা ভেঙে যায়। পঞ্চায়েত গত কুড়ি বছর ধরে টোল ট্যাক্স আদায় করছিল। কিন্তু সংস্কারের কাজ কিছুই হয় না। এখন গ্রামবাসীরা সচেতন হয়েছেন। প্রতিবাদ করতে শিখেছেন। টোল ট্যাক্স দেবেন কেন? আর যদি দিতেই হয় তা হলে দেবেন পঞ্চায়েতকে।”
বিডিও জয়ন্ত মণ্ডল বলেন, “পঞ্চায়েত দায়িত্ব পালন করতে পারছিল না বলেই তো পঞ্চায়েত সমিতিকে দায়িত্ব দেওয়া হল। তা ছাড়া, টোল তো সাধারণ গরিব মানুষের থেকে আদায় করা হচ্ছে না। ইট-বালি বোঝাই ব্যবসায়ীদের গাড়ি থেকেই তা নেওয়া হবে।” পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিকে যখন নিজেদের সম্পদ ও আয় বাড়ানোর জন্য সরকারি তরফেও জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন এই পরিস্থিতি নেহাতই অনভিপ্রেত বলে প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের বক্তব্য। গোটা বিষয়টি মহকুমাশাসক ও জেলাশাসককে জানানো হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিডিও।
শুক্রবার বিকেলে বিডিওর নির্দেশে ফের টোল আদায় করতে এলাকায় লোক পাঠান মৃণালকান্তিবাবু। তিনি নিজেও ছিলেন সঙ্গে। সে সময়ে তৃণমূলের কিছু লোক এসে তাঁদের লাঠিসোঁটা নিয়ে মারধর করে তাড়িয়ে দেয় বলে অভিযোগ। জখম হন মৃণালকান্তিবাবু-সহ চার জন। লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে পুলিশকে।
সিপিএম সাংসদ শক্তিমোহন মালিক বলেন, “খবরটি পেয়েছি। গোটাটাই তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। ঠিকাদার যে গোষ্ঠীর লোক, তার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীই এই কাণ্ড ঘটাচ্ছে।” এই যুক্তি অবশ্য মানতে চাননি গোঘাটের তৃণমূল নেতা মনোরঞ্জন পাল। তিনিও বলেন, “গ্রামের লোকেরা কিছু আপত্তি তুলেছে। আলোচনার মাধ্যমে মিটেও যাবে।” |
|
|
|
|
|