গ্যাংটকে ভেঙে পড়ল পাঁচতলা বাড়ি, ভাইচুংদের ক্লাবঘর
ভূমিকম্পের দাপটে গ্যাংটকের রাস্তা জুড়ে নানা রাজ্যের অসহায় মুখ। এ বার ভূমিকম্পের শিকার হলেন সিকিমের সবচেয়ে পরিচিত মুখ ভাইচুং ভুটিয়াও।
ব্যক্তিগত কাজে ভাইচুং নিজে ছিলেন পুণে ও মুম্বইয়ে। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যায় গ্যাংটকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল তাঁর সাধের ইউনাইটেড সিকিম ক্লাবের নিজস্ব ঘর। বালুয়াখানি অঞ্চলে ওই পাঁচতলা বাড়িতেই থাকতেন ভাইচুংয়ের ছোটবেলার অভিভাবক ও আত্মীয় কর্মা ভুটিয়া। একটা আওয়াজ শুনে বাড়ির বাসিন্দাদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন প্রবীণ কর্মা। সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে ওই পাঁচতলা বাড়ি। বিকেল থেকেই শহরে ছিল বৃষ্টি। তার মধ্যে সন্ধে সাতটা নাগাদ এই ঘটনা।
কর্মার হাত ধরেই এক দিন কলকাতায় এসেছিলেন ভাইচুং। অনেক দিন পর্যন্ত তিনিই ভাইচুংয়ের দেখভাল করতেন। খুব সুন্দর সাজানো বাড়ি ছিল তাঁর। নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। কর্মা আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়ের বাড়ি।
ভেঙে পড়া পাঁচতলা বাড়ি থেকে চলছে উদ্ধারের কাজ। বৃহস্পতিবার গ্যাংটকে। ছবি: এএফপি
রেনেডি সিংহ-সহ সিকিম ইউনাইটেডের ফুটবলারদের নিয়ে আজ সকালেও গ্যাংটকে প্র্যাক্টিস করেছেন কোচ স্ট্যানলি রোজারিও। বৃহস্পতিবারও ভূমিকম্প হওয়ায় দেশি-বিদেশি ফুটবলাররা দারুন আতঙ্কে রয়েছেন। দলের ম্যানেজার অরুণাভ ভট্টাচার্য জানালেন, শুক্রবারই ঠিক হয়েছিল দলের সবাই শিলিগুড়িতে চলে যাবেন। সেখানেই হবে প্র্যাক্টিস। কর্মীরা ক্লাবঘর থেকে বল-সহ বিভিন্ন জিনিস বাইরে বার করে আনেন। তার সামান্য পরেই বাড়িটি ভেঙে পড়ে। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, কিট ভাইচুংদের ক্লাবের সব গিয়েছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে সব ট্রফিও। উদ্বিগ্ন ভাইচুং শনিবার গ্যাংটক ফিরছেন।
গ্যাংটক শহরের ‘বজ্র’ সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকায় ছিল ইউনাইটেড সিকিমের ক্লাবঘর। ওই বাড়িতে একটি ব্যাঙ্কের এটিএম-ও ছিল। সেটাও ধসে গিয়েছে। কর্মা ভুটিয়াদের বাড়ির লাগোয়া আর একটি বাড়িও বিপজ্জনক ভাবে হেলে পড়েছে। সিকিম প্রশাসন সূত্রের খবর, ভেঙে পড়া বাড়িটিতে এখনও কয়েক জন আটকে রয়েছেন। ঘটনাটা বাড়িয়ে দিয়েছে ভয়। সিকিম ইউনাইটেড কোচ স্ট্যানলি বললেন, “কাল রাত থেকে বৃষ্টি। সব কিছু স্বাভাবিক হতে হতেও হচ্ছে না।” অরুণাভ বললেন, “কর্মা ভুটিয়া আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছেন।
উনি ঠিক আছেন। আমাদের ফুটবলারদের চুক্তিপত্রগুলি কোনও মতে বেঁচে গিয়েছে।” স্বীকার করলেন, ফুটবলাররা সবাই আতঙ্কে ভুগছেন।
ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে দিয়েছে গ্যাংটকের ইচে মঠের লামাদের আবাসন। ছবি: সন্দীপ পাল।
এই আতঙ্ককে অস্বাভাবিকও বলা যাচ্ছে না। গ্যাংটকের কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের আধিকারিক গোপীনাথ রাহা বলেন, “টানা বৃষ্টিই ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে।” বৃহস্পতিবার মাটি কেঁপে ওঠার পরে রাতভর পথেই কাটিয়েছেন গ্যাংটক ও লাগোয়া এলাকার বহু মানুষ। ভিড়ের মধ্যে দেখা গিয়েছে নেতা-মন্ত্রীদেরও। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল পুলিশ-প্রশাসন। নেতা-কর্তাদের আশ্বাস সত্ত্বেও ভোরের আলো ফোটার আগেই ব্যাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে গাড়ি ধরার জন্য লাইন দিয়েছিলেন ত্রিপুরার বাসিন্দা পর্যটক তপন শর্মা। বললেন, “বউ-বাচ্চা হোটেলে রয়েছে। গাড়ির খোঁজে বেরিয়েছি। কে কী আশ্বাস দিয়েছে জানি না। শুনতেও চাই না। এখন বাড়ি ফিরতে পারলে বাঁচি।”
ব্যবসা সূত্রে ২৪ বছর ধরে গ্যাংটকে বসবাস করছেন আশাদেবী চৌধুরী। রবিবারের পরে বৃহস্পতিবারেও মাটি কেঁপেছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও ভাবেই আর গ্যাংটকে থাকতে রাজি নন তিনি। দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এ দিনই সকালে তিনি উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের পথে রওনা হলেন। বললেন, “৬-৭ মাসের আগে ফিরছি না। জীবনের দাম আছে।” এম জি মার্গের হোটেলের কর্মী পাঁচ যুবক এ দিন সকালে গাড়িতে চড়ে বসেন। তাঁদেরই এক জন শ্যামল দেবনাথ বললেন, “১২ বছর ধরে কাজ করছি। মালিক ছাড়তে চাইছিলেন না। তাই চাকরি ছেড়েই পাকাপাকি ভাবে চলে এলাম। আর ফিরতে চাই না।”
ধস সরিয়ে ফের চালু হয়েছে রাস্তা। সিকিমের রানিপুলে। শুক্রবার সন্দীপ পালের তোলা ছবি।
পায়ের তলার মাটির ‘মতিগতি’র উপরে ভরসা হারানো মানুষ এ দিন কাকভোর থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছেন গ্যাংটকের বাস ও ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে। ঠেলাঠেলি, ঠাসাঠাসি। কী ভাবে পৌঁছনো যাবে শিলিগুড়ি! মওকা বুঝে গাড়ির ভাড়াও আকাশছোঁয়া। তাতে কী! যে ভাবেই হোক গ্যাংটক ছাড়ার তাড়া সকলের। কিন্তু গাড়ি প্রায় নেই। রাস্তাঘাটের হাল দেখে অনেক গাড়ি শিলিগুড়িতেই রয়ে গিয়েছে। যে ক’টি রয়েছে, তাদের চালকেরা অনেকেই গাড়ি নিয়ে রাস্তায় বেরোতে রাজি নন। তাই দু-তিন গুণ ভাড়া কবুল করে গাড়ি জোগাড়ের চেষ্টা চলছে। দিনভর গ্যাংটকের পথে চোখে পড়েছে এমনই দৃশ্য। এ দিকে, ভূমিকম্পে সিকিমের বিভিন্ন প্রান্তে ক্ষয়ক্ষতি হলেও দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত রয়েছে বলে জানিয়ে দিলেন সেনাবাহিনীর ৩৩ কোরের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল বিনোদ ভাটিয়া। এ দিন তিনি সুকনায় বাহিনীর সদর দফতরে বসে বলেছেন, “কেবল উত্তর সিকিমে দু’জন সেনা জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে এবং ১৫ জন জখম হয়েছেন। সমস্ত সেনা চৌকি সুরক্ষিত এবং ঠিকঠাক রয়েছে। চিন্তার কারণ নেই। আমরা এখন সিকিমে ত্রাণ পৌঁছনো, রাস্তাঘাট নতুন করে তৈরির কাজ করছি।”
লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভাটিয়া জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পরে ২১ জায়গায় ধস পরিষ্কার করে সেবক থেকে গ্যাংটক ৩১-এ জাতীয় সড়ক খোলা হয়। চুংথাং, এমনকী, রবিবারের ভূ-কম্পের উৎসস্থল মঙ্গন পর্যন্ত রাস্তা খোলা হয়েছে। সিকিম সরকারের সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ চলছে। ৮টি ত্রাণ-শিবিরে বাসিন্দাদের থাকা-খাওয়া, ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ আরও ১৮টি দেহ উদ্ধার হওয়ায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৫। প্রতিদিন হেলিকপ্টারে জখমদের আনা হচ্ছে। সেনা হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা চলছে। ১২ জন বিদেশি-সহ ২০৬ জন পর্যটককে উদ্ধার করা হয়েছে। বর্তমানে ২ হাজার জওয়ান ত্রাণ বণ্টন এবং উদ্ধারের কাজে ব্যস্ত। ১৪টি হেলিকপ্টারের সাহায্যে একশোর বেশি গ্রামে খাবার, ওষুধপত্র-সহ ত্রাণ পাঠানো হয়েছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.