নরেন্দ্র মোদীকে কড়া বার্তা দিতেই তাঁর রথযাত্রায় কট্টর মোদী-বিরোধী নীতীশ কুমারকে পাশে টানলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। বিজেপি-র মধ্যেই মোদীকে কোণঠাসা করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নন নীতীশও। তাই আডবাণীর এই দুর্নীতি-বিরোধী রথযাত্রার সূচনা করার ‘সম্মান’ সাগ্রহেই গ্রহণ করছেন তিনি।
আডবাণীর রথযাত্রা উদ্বোধনের প্রস্তাব এনডিএ শরিক জেডিইউ-এর নেতা তথা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে দেন বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী। প্রাথমিক ভাবনা-চিন্তার পরে নীতীশ সেই প্রস্তাবে সায় দিতেই আজ বিজেপির তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে সে কথা ঘোষণা করে দেন দলের মুখপাত্র রবিশঙ্কর প্রসাদ। তিনি জানান, “আগামী ১১ অক্টোবর জয়প্রকাশ নারায়ণের জন্মস্থান, বিহারের সিতাবদিয়ারা থেকে আডবাণী রথযাত্রা শুরু করবেন। বিজেপি সভাপতি নিতিন গডকড়ী বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রথযাত্রার উদ্বোধন করার অনুরোধ জানিয়েছেন। নীতীশও তাতে সম্মতি দিয়েছেন।”
দু’দশক আগে ভারত-সফরে বেরিয়ে এই বিহারেই আটকে গিয়েছিল লালকৃষ্ণ আডবাণীর রামরথের চাকা। দিনটা ছিল ২৩ অক্টোবর। আর এ বারে সেই বিহার থেকেই রথ নিয়ে যাত্রা শুরু করবেন আডবাণী! এবং সেই অক্টোবর মাসেই! গোড়ায় অবশ্য নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত থেকে রথযাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলেন আডবাণী। কিন্তু মোদী সেই প্রস্তাবে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। উল্টে নিজের ভাবমূর্তি বাড়াতে ‘সদ্ভাবনা অনশনে’ বসেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা বদলে আডবাণী ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা রথযাত্রা শুরুর জন্য বিহারকে বেছে নেন। আনুষ্ঠানিক ভাবে সেই যাত্রার সূচনা করার জন্য তাঁরা বেছে নেন সহযোগী-শরিক দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা নীতীশ কুমারকে। |
মোদী-নীতীশ দূরত্বের কথা রাজনীতিতে সর্বজনবিদিত। গত বছর পটনায় বিজেপি-র জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মোদীর আসা এবং সেখানে তাঁর আচরণে ক্ষুব্ধ নীতীশ বিজেপি-র সর্বভারতীয় নেতৃত্বের জন্য দেওয়া ভোজসভাই প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। গত বছর বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারেও মোদীকে তিনি বিহারে ঢুকতে দেননি। এ হেন মোদী-বিরোধী নীতীশের প্রথম ও প্রধান শর্তই ছিল, রথযাত্রার সূচনা অনুষ্ঠানের ধারেকাছেও যদি মোদীর ছায়া দেখা যায়, তবে তিনি থাকবেন না। এর পরেই বিজেপি নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেন, এই সূচনা অনুষ্ঠানে বিজেপি-শাসিত কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই আসবেন না। পটনায় জেডিইউ সূত্রের খবর, বিজেপি নেতৃত্বের থেকে বিষয়টি জানার পরেই নীতীশ সম্মতি দিয়েছেন।
১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর গুজরাতের সোমনাথ মন্দির থেকে তাঁর রাম-রথযাত্রা শুরু করেছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। সেই উপলক্ষে প্রতি বছর ২৫ সেপ্টেম্বর আডবাণী সোমনাথ দর্শনে যান। কিন্তু মোদীর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ায় এ বারে সম্ভবত আর সোমনাথে যাবেন না আডবাণী। আর ওই ২৫ সেপ্টেম্বরই আমদাবাদ-গাঁধীনগরে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করেছেন নরেন্দ্র মোদী। আসলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আগামী লোকসভা নির্বাচনে আডবাণীকে ধর্তব্যের মধ্যে না রেখে মোদীকেই সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করার ইঙ্গিত দিতেই বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জলঘোলা শুরু হয়ে যায়। সঙ্ঘ পরিবারের চাপ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড় থেকে সরে যাওয়ার কথা আডবাণী খুব একটা স্পষ্ট করে বলেননি। বরং তিনিই যে এখনও বিজেপি-র প্রধান নেতা, তা প্রমাণে উঠেপড়ে লেগেছেন। আডবাণীর এই অবস্থানে সঙ্ঘ নেতৃত্ব খুব একটা সন্তুষ্ট নয়। ফলে রথযাত্রায় বেরিয়ে তাদের সমর্থন কতটা মিলবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়েই যাচ্ছে। এই অবস্থায় মোদী এবং সঙ্ঘ নেতৃত্বকে বার্তা দিতেই নীতীশকে বেছে নিয়েছেন আডবাণী। তিনি বোঝালেন, বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারে না হোক, এনডিএ শরিকদের কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। আর এনডিএ-র দ্বিতীয় বৃহত্তম শরিক জেডিইউ-কে বাদ দিয়ে যে প্রধানমন্ত্রী পদের সরল পাটিগণিত মিলতে পারে না, সে কথাটাই পরোক্ষে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সব শিবিরকে।
রথযাত্রার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মোদীর না থাকা প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর বলেন, “আডবাণীর রথ যে হেতু বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মধ্যে দিয়ে যাবে, তাই সেখানেই সেই সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিভিন্ন নেতা হাজির থাকবেন।” বিহারের উপ-মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সুশীল মোদী আবার বলেছেন, “রথযাত্রার উদ্বোধনে বিজেপির কোনও মুখ্যমন্ত্রীই উপস্থিত থাকছেন না। তাই নীতীশজির ওখানে যেতে আপত্তি থাকার কথা নয়।” নরেন্দ্র মোদী না থাকলে রথযাত্রা উদ্বোধনে তাঁদের যে আপত্তি নেই, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন জেডিইউ মুখপাত্র শিবানন্দ তিওয়ারি। তিনি বলেন, “বিজেপির সঙ্গে আমরা এ রাজ্যে ছ’বছরেরও বেশি ক্ষমতায় রয়েছি। এনডিএ-তে আমরা এক সঙ্গে রয়েছি প্রায় পনেরো বছর। এর আগেও বহু বার নীতীশ কুমার আডবাণীর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নিয়েছেন। তাই এতে নতুন করে কোনও বিতর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’’
তবে আডবাণীর রথযাত্রায় অংশগ্রহণ নিয়ে জেডি(ইউ)-এর অন্দরে বিতর্ক রয়েছে। একাংশের বক্তব্য, আডবাণীর সঙ্গে মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া আর রথযাত্রার উদ্বোধন করা, দু’টো এক নয়। রাজ্য-রাজনীতিতে লালুপ্রসাদ যাদব এই বিষয়টিকে হাতিয়ার করতে ছাড়বেন না। ওই নেতাদের আশঙ্কা, সংখ্যালঘু ভোট টানতে লালু বলতেই পারেন, আমি আডবাণীর রথ বিহারে থামিয়ে ছিলাম। আর বিহার থেকেই সেই নীতীশের রথযাত্রার সূচনা করলেন নীতীশ! তাতে দলের ক্ষতি হতে পারে। |