ভবানীপুর কেন্দ্রে উপনির্বাচন ‘অকাল ভোটে’ মমতার
আসল লড়াই মার্জিনের
কে তুমি? নন্দিনী?
হাল্কাচালে বললেন তৃণমূলের স্বভাব রসিক মন্ত্রী। গলায় স্পষ্টতই তাচ্ছিল্য। যার মোদ্দা কথা গলিয়াথের সঙ্গে লড়াইয়ে নেমেছে ডেভিড! এই আর কী!
ভবানীপুরের বস্তি, বহুতল আর অলিগলিতে যিনি সিপিএমের তাবড় নেতাদের সঙ্গে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি বললেন, “অসম লড়াইয়ের ব্যাপার নেই। আমি মনে করি, মতাদর্শের বিচারে আমরা বামপন্থীরাই এখন এগিয়ে।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর শিক্ষিকা। পঁয়তাল্লিশের নন্দিনী ‘ডেভিড’ মুখোপাধ্যায়কে দেখতেও বড্ড শিক্ষিকা-শিক্ষিকা। চোখে চশমা। তাঁতের শাড়ি। কাঁধে ব্যাগ। কথাবার্তাও বেশ গুছিয়ে বলেন। সিপিএম-সুলভ, “তিন মাসেই মানুষ বুঝতে পারছে আমাদের সঙ্গে তৃণমূলের তফাত! জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে, কেন্দ্রের কংগ্রেস-তৃণমূল জোট সরকারের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি ও কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে আমরা মানুষকে বলছি। বলছি পরিবর্তনের পর রাজ্য জুড়ে খুন-সন্ত্রাসের কথা। মানুষ আমাদের ভুল বুঝেছিলেন। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।”
প্রচার চলছে জোরকদমে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে মিছিল
তৃণমূলের সমর্থকদের। ভবানীপুরে। অশোক মজুমদারের তোলা ছবি
কিছু তো বলতেই হবে! মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রার্থী বলে কথা! তা-ও আবার অকাল-ভোটে!
কিন্তু ‘অকাল বোধনের’ আগে ভবানীপুরের ‘অকাল ভোট’ কবে?
২৫ সেপ্টেম্বর। রবিবার।
ভুল হল। ২৫ নয়। ভবানীপুরের ভোট ২৮ সেপ্টেম্বর। বুধবার। সে দিন ভোটের ফলাফল। যার দিকে তাকিয়ে সাধারণ তৃণমূল কর্মী থেকে শুরু করে তামাম রাজ্যবাসী কত ব্যবধানে জিতলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
তাঁর জীবনের প্রথম বিধানসভা ভোটে মমতা যে জিতবেন, তা নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই। সম্ভবত নন্দিনীদেবীরও নেই। তিনি অবশ্য বলেছেন, “হারার জন্য তো কেউ ভোটে লড়তে নামে না!” সে তো বলবেনই। নির্দল প্রার্থীরাও বলেন! কিন্তু তিনি আদৌ দাঁড়াতে রাজি হলেন কেন? আলিমুদ্দিন প্রথমে যাঁর কথা ভেবেছিল, তিনি মমতার বাড়ির অদূরে আশুতোষ কলেজের স্নাতকোত্তর বাংলা বিভাগের ‘অ্যাসোশিয়েট প্রফেসর’ চন্দ্রমল্লি সেনগুপ্ত। তিনি তো রাজি হননি? চন্দ্রমল্লি অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাবই দেওয়া হয়নি! কিন্তু এর আগে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটির ভোটে অংশ নেওয়া এবং শিবপুর বিই কলেজে ছাত্রী থাকাকালীন ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেওয়ার (সেই সময়ে সেটাই নাকি খুব বড় ব্যাপার ছিল! ছাত্রদের মিছিলে দু’জন ছাত্রী হাঁটছেন) অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নন্দিনীদেবী কেন সায় দিলেন? এর জবাবও একেবারে সিপিএম-সুলভ, “পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমায় প্রার্থী হতে বলা হয়েছে। আমি হয়েছি।”
বামেদের প্রচারে মহম্মদ সেলিম ও বিমান বসু। রয়েছেন প্রার্থী নন্দিনী
মুখোপাধ্যায়ও। একবালপুরে। শুক্রবার দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি।
নন্দিনীদেবী প্রার্থী হয়েছেন। আড়মোড়া ভেঙে ময়দানে নেমেছে পার্টি। জিপযাত্রা করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। হাজরা পার্কে তাঁর হয়ে নির্বাচনী সভা করেছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুরা। কেন? কেন আবার, এটা বোঝাতে যে, সিপিএম হারার আগেই হেরে যায়নি! আর, যদি কয়েক মাস আগের বিধানসভা ভোটে হারের ব্যবধান ৫০ হাজার থেকে একটুও কমিয়ে আনা যায়, তা হলে আলিমুদ্দিনের ‘নৈতিক জয়’ ঠেকায় কে!
সাধে কি প্রচারের ফাঁকে সিপিএম নেতা অজিত মিত্রের সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য, “তৃণমূলকে ফাঁকা মাঠে গোল করতে দেব না।” তার পর একটু বিশদ অঙ্কে, “ভবানীপুরে ভোটার ২ লক্ষ ২০ হাজার। গত বিধানসভা ভোটে ৬৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আমরা পেয়েছিলাম প্রায় ২৮ শতাংশ। এ বার পুজোর ঠিক আগে ভোট। মানুষ এখন উৎসবের মেজাজে। ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে বলে মনে হয় না। তবে আমাদের ভোটের শতাংশের হার বাড়বেই।”
কিন্তু আলিমুদ্দিনের ‘বিড়ম্বনা’র যে শেষ নেই! গত বিধানসভা ভোটে ভবানীপুরে সিপিএমের প্রার্থী নারায়ণ জৈন প্রচার শুরু করে দিয়েছেন ‘দিদি’র হয়ে! যিনি এখন দাবি করছেন, “যা ভোট পড়বে, তার ৮৫ শতাংশই দিদি পাবেন!”
সে সব ২৮ তারিখ বোঝা যাবে। কিন্তু মুশকিল হল, গল্ফ গার্ডেন রোডের বাসিন্দা নন্দিনীদেবীকে যাঁর বিরুদ্ধে ঠেলে দিয়েছেন রবীন দেব প্রমুখ, তিনি আবার ভবানীপুরের ‘ঘরের মেয়ে’। এলাকার প্রতি বাড়িতে তাঁর নিজের হাতে লেখা আবেদনে যিনি বলেছেন, ভবানীপুরের ‘মা-ভাই-বোনেরা’ কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাসিন্দা মমতাকে ‘ছোটবেলা থেকেই মা-মাটি-মানুষের হয়ে পথ চলতে সাহায্য করেছেন’।
কিন্তু তিনি আবার রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও হয়ে বসেছেন!
১৯৯১ থেকে দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মমতা। কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা প্রাথমিক পরিচয় প্রার্থী। প্রথমে কংগ্রেস, পরে তৃণমূলের। এ বার কিন্তু তিনি নিছক ‘তৃণমূল প্রার্থী’ নন। যিনি এলাকায় দু’দিন পদযাত্রা করে জনতার ঢেউয়ে সওয়ার হলেন, তিনি ‘মুখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে মহাকরণে চার মাসেরও বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছেন। এবং প্রায় সহবাগের মতো ব্যাট চালিয়ে। তবে আবার সে জন্যই তাঁর ‘চাপ’ বেশি। ‘চাপ’ দলেরও মুখ্যমন্ত্রীকে রেকর্ড ভোটে জেতানোর। ‘চাপ’ এই উৎসবের মরসুমে ভোটারদের বাড়ি থেকে বুথে টেনে আনার। বৃষ্টি বরাবরই মমতার পক্ষে শুভ। এই ভোটেও। নিছকই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কায় ইডেন থেকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচ সরে গিয়েছে হায়দরাবাদে। নইলে রবিবার কলকাতায় নাইট রাইডার্সের খেলা থাকার কথা!
এমনিতে ভবানীপুর ‘ভূমিকন্যা’ মমতার ‘মজবুত দুর্গ’। তবুও পুজোর মুখে ভোট বলে কিঞ্চিৎ চিন্তায় মুখ্যমন্ত্রীর ‘সেনাপতিরা’। ভিড়ে-ঠাসা পদযাত্রায় মমতা সম্ভবত সেই জন্যই ‘অকাল ভোটে’র জন্য ক্ষমা চেয়েছেন এলাকার মানুষের কাছে। বিধানসভা ভোটের সময় দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার ও ভোট পরিচালনার জন্য তিনি নিজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পাননি জানিয়ে মমতা তাঁর ‘আবেদনে’ বলেছেন, ‘আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসাবে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু ছ’মাসের মধ্যে আমায় বিধানসভার সদস্য হতে হবে’। মানুষ যে ‘উৎসবের মেজাজে’ তা-ও জানেন। তবে ‘ভোটের দাম অনেক’, এ কথা আরও এক বার জানিয়ে মমতা তাঁর আবেদনে ভোটারদের বলেছেন, ‘আপনাদের প্রত্যেকের এক-একটা অমূল্য ভোটপ্রাপ্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করবেন না’।
২৮ তারিখ ভবানীপুরে মমতারও পরীক্ষা নয় আসলে। সে দিন পরীক্ষা গোটা তৃণমূলের! আর নন্দিনীদেবী? তৃণমূলের স্বভাব রসিক মন্ত্রী, “জীবনে কী পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা।” বৃত্ত সম্পূর্ণ হল?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.