সামান্য একটা চড়াই পাখি!
মরে পড়েছিল কলকাতা বিমানবন্দরের রানওয়েতে। আর তার জন্যই সময়ে নামতে পারল না দু’-দু’টো বিমান! যতক্ষণ না মৃত চড়াইকে সরানো হল, সেই প্রায় দশ মিনিট তারা চক্কর কাটল আকাশে। বিমানবন্দরের এক অফিসারের ব্যাখ্যা, “রানওয়ে থেকে ওঠা-নামার সময়ে বিমানের যা গতি থাকে, তাতে চাকার তলায় ছোট্ট চড়াই পড়লেও বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা।”
প্রতি পদে যেখানে এত সতর্ক থাকার কথা, যেখানে সামান্য চড়াই পাখিও বিপর্যয় ঘটিয়ে দিতে পারে, বাস্তবে কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে শিউরে ওঠার মতো কিছু দৃশ্যও! যেমন?
যেমন, কাউকে কিছু না-জানিয়ে উড়তে ওঠা বিমানের সামনে চলে আসছে জিপ! কখনও যাত্রীবোঝাই বাস সাঁ বেরিয়ে যাচ্ছে পাইলটের নাকের ডগা দিয়ে! কখনও বা কেউ দিব্যি হেলতে-দুলতে হেঁটে পেরোচ্ছেন রানওয়ে! সম্প্রতি একাধিক বিমানের পাইলটের কাছ থেকে এই ধরনের গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। |
ঘটনার সময়ে ওঁদের কেউ বিমান নিয়ে কলকাতা ছেড়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। কেউ আবার অবতরণের সময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন এমন ‘ভয়ঙ্কর’ কাণ্ডকারখানা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই একচুলের এ-ধার ও-ধার হলে কল্পনাতীত বিপর্যয় ঘটে যেতে পারত। অভিযোগ পেয়ে এ বার তদন্তে নামছে ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ সিভিল অ্যাভিয়েশন (ডিজিসিএ)।
কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর: নিরাপত্তা লঙ্ঘনের সবচেয়ে সাংঘাতিক ঘটনাটি ঘটেছে গত ২৯ অগস্ট। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ স্পাইসজেটের বিমান কলকাতা থেকে যাত্রী নিয়ে বেঙ্গালুরু রওনা দেয়। রানওয়ে ছেড়ে উড়ে যাওয়ার ঠিক পরমূহূর্তে পাইলট দেখতে পান, একটা জিপ প্রায় বিমানের তলা দিয়ে আড়াআড়ি ভাবে রানওয়ে পার হয়ে গেল!
হতচকিত পাইলট এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এ যোগাযোগ করেন। এটিসি-অফিসারেরা জানান, কোনও জিপকে রানওয়ে অতিক্রমের অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু ঘটনা হল, সময়ের সামান্য হেরফেরে জিপটা যদি বিমানের সামনে চলে আসত, তা হলে ২৯ অগস্ট একটি মর্মান্তিক বিমান-দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকত কলকাতা বিমানবন্দর। একই কাণ্ড হতে পারত ৬ সেপ্টেম্বরে, যে দিন সকালে গুয়াহাটিগামী এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান গড়িয়ে গড়িয়ে রানওয়ের দিকে যাওয়ার সময়ে পাইলটকে চমকে দিয়ে তাঁর নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল জেট এয়ারওয়েজের যাত্রী-বাস! হতে পারত তার পরের দিনও। কারণ, সেই ৭ সেপ্টেম্বর সকালে দিল্লি থেকে আসা ইন্ডিগো উড়ানের পাইলট কলকাতায় অবতরণের সময়ে এটিসি-কে অভিযোগ করেছিলেন, রানওয়ের কাছে অনেক লোক ও গাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে! আবার সে দিনই চেন্নাই থেকে এসে কলকাতায় নামতে গিয়ে জেটের পাইলট দেখেন, হেঁটে রানওয়ে পেরোচ্ছে এক জন! অনেকটা রাস্তা পার হওয়ার মতো, ঘাড় ঘুরিয়ে এ-পাশ ও-পাশ দেখেশুনে সে নিশ্চিন্তে রানওয়ে পেরিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন জেটের পাইলট।
দেখা যাক, রানওয়ের নিরাপত্তা-বিধি কী বলছে।
বিশ্ব জুড়ে অসামরিক বিমান পরিবহণ নিয়ন্ত্রণ করে যারা, সেই ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (ইকাও)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, এটিসি-র অনুমতি ছাড়া কেউ রানওয়েতে ঢুকতে পারবে না। কারণ, কখন কোন বিমান নামছে-উড়ছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব একমাত্র এটিসি-র কাছেই থাকে। ইকাওয়ের কড়া নির্দেশ, মেরামতি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ ছাড়া অন্য কোনও কারণে রানওয়েতে ঢোকা যাবে না। এবং তখনও হেঁটে যাওয়ার প্রশ্ন নেই, লাগবে গাড়ি। সেই গাড়িকে ওয়াকিটকি মারফত সর্বদা এটিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। রানওয়ের অনেক দূরে, পাঁচিলের গা ঘেঁষে থাকা ‘পেরিফেরি-রোড’ ধরে যাবতীয় গাড়ি চলাচল করবে। বিমান ও বিল্ডিংয়ের মধ্যে যাত্রী বা মাল নিয়ে যাতায়াত করা গাড়ির জন্য আলাদা পথ নির্দেশিকা রয়েছে। যা অমান্য করলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে। যে কারণে বিমানবন্দরের ভিতরে যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদের আলাদা প্রশিক্ষণ দিয়ে বিশেষ লাইসেন্স দেওয়া হয় বলে ডিজিসিএ-সূত্রের খবর।
কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় প্রমাণ, প্রশিক্ষণ পেয়েও অনেকে কিছুই শেখেননি! ডিজিসিএ তাই ওই সব চালকের জন্য ফের প্রশিক্ষণ-কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এ সম্পর্কে বিমানবন্দরে নোটিসও পড়েছে। এর পরেও বিধি লঙ্ঘিত হলে? তখন সংশ্লিষ্ট চালকের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁর লাইসেন্স বাতিলও হতে পারে। কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশনস) রাকেশ সিংহের কথায়, “নিয়ম না-মানলে জরিমানা হচ্ছে। লাইসেন্সও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। কিছু কর্মীকে নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু তাতেও সমস্যা একেবারে মিটছে না! কেন?
কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বিমানবন্দরের ভিতরে উড়ান ও যাত্রীসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যানবাহনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অথচ এলাকা বাড়ছে না। উল্টে আধুনিকীকরণের কাজের দরুণ কিছু জায়গা কমে গিয়েছে। এই অবস্থায় গাড়িচালকদের ‘আরও সচেতন’ হওয়া ছাড়া সমস্যার অন্য সমাধান নেই বলেই মনে করছে ডিজিসিএ। |