‘দুয়োরানি’ ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের সমস্যা খুঁজতে এ বার পেশাদার প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সমীক্ষার পথে হাঁটছে রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে এই শিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি, তাদের রুগ্ণতার কারণ এবং বিভিন্ন সমস্যার শিকড় খুঁজতে ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই)-কে এই সমীক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতর।
বড় সংস্থার জন্য যে কৌলিন্য বা গুরুত্ব সযত্নে তোলা থাকে, সাধারণত তার ছিটেফোঁটাও জোটে না ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের কপালে। অথচ এক অর্থে এ রাজ্যের ‘পেটে ভাত জোগায়’ এই ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পই। প্রচারের আলোর সিংহভাগ ভারী শিল্প টেনে নিলেও, কুটির শিল্প কিংবা ছোট ছোট সংস্থায় কাজ করেই জীবিকা অর্জন করেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। একমাত্র কৃষি ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রের উপরেই এত পরিবারের দিন গুজরান নির্ভরশীল নয়। তা ছাড়া, আগামী দিনেও পাতে দেওয়ার মতো বড় বিনিয়োগের অভাবে কর্মসংস্থানের জন্য হয়তো এই ক্ষেত্রের দিকেই তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হবে রাজ্য। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও, ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের হাল-হকিকত কিংবা সমস্যা নিয়ে কোনও তথ্যই প্রায় মজুত নেই রাজ্য সরকারের ঘরে। ২০০৬-’০৭ সালের কেন্দ্রীয় সমীক্ষার পর এ নিয়ে আর উদ্যোগী হয়নি পূর্বতন বাম সরকারও। যে কারণে এ বার সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আইএসআই-কে দিয়ে সমীক্ষা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
এ প্রসঙ্গে ছোট ও মাঝারি শিল্পমন্ত্রী মানস ভুঁইঞা জানান, “এই শিল্পের সংখ্যা জানতে ২০০৬-’০৭ অর্থবর্ষে একটি সমীক্ষা করেছিল কেন্দ্র। তা অনুযায়ী, তখন রাজ্যে এ রকম প্রায় ২৫ লক্ষ সংস্থায় কাজ করতেন ৫৮.৩০ লক্ষ মানুষ। ওই সব সংস্থার অনেকগুলিই হয়তো এখন বন্ধ কিংবা রুগ্ণ। কিন্তু সে সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই রাজ্যের হাতে। অথচ ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পই আর্থিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। এই শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য সমীক্ষা জরুরি। তাই অর্থ দফতর অনুমোদন দেওয়ার পরই সেই দায়িত্ব আইএসআই-কে দেওয়া হয়েছে।”
রাজ্যের অর্থনীতিতে এই শিল্পের প্রভাব যে কতখানি, তা স্পষ্ট ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি শিল্প দফতরের সচিব তথা অতিরিক্ত মুখ্য সচিব অনুপ চন্দের কথাতেও। তিনি বলেন, “২০০৬-’০৭ সালের কেন্দ্রীয় সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজ্যে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প সংস্থা ছিল ২৫ লক্ষ ১৩ হাজার। কিন্তু তার মধ্যে নথিভুক্ত সংস্থার সংখ্যা মাত্র সাড়ে ৪২ হাজার। যেখানে কাজ করতেন প্রায় ৩.৬৫ লক্ষ জন। রাজ্যের নিজস্ব পরিসংখ্যান মাফিক গত ৩০ জুন পর্যন্ত ওই নথিভুক্ত সংস্থার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬৩ হাজার। আর শুধু সেখানেই কাজ করছেন প্রায় ৬.৭২ লক্ষ কর্মী। ফলে, এর বাইরে যে বিপুল সংখ্যক সংস্থা রয়েছে, তার উপর কত জনের জীবিকা নির্ভর করছে, তা সহজেই অনুমেয়।”
কিন্তু ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য কেন এ ধরনের সমীক্ষা জরুরি?
মন্ত্রী মনে করেন শুধুমাত্র শিল্পমহলের দেওয়া কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য বা সরকারি অনুমানের ভিত্তিতে রুগ্ণ ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্পের পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা করা অসম্ভব। বরং এর জন্য পূর্ণাঙ্গ তথ্য হাতে থাকা জরুরি। অনুপবাবুর মতেও, ‘‘শুধু সংস্থার সংখ্যা জানাই যথেষ্ট নয়। নীতি নির্ধারণের জন্য সংশ্লিষ্ট সমস্ত বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য থাকা জরুরি। যেমন, এ ক্ষেত্রে মূলধনের সমস্যা নাকি সরকারি সাহায্যের অভাব ঠিক কীসের জন্য সংস্থা রুগ্ণ হয়ে পড়ছে, তা নির্দিষ্ট করে জানা প্রয়োজন। তবেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।”
তাঁদের সঙ্গে একমত ফেডারেশন অফ স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম ইন্ডাস্ট্রিজ-এর প্রেসিডেন্ট বিশ্বনাথ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “অনেক সংস্থা হয়তো ছোটখাটো কারণেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একমাত্র তৃণমূল স্তরে সমীক্ষা হলেই সেগুলি খতিয়ে দেখা সম্ভব।”
সংশ্লিষ্ট মহলের অভিযোগ, ঠিক কোন কোন মাপকাঠির ভিত্তিতে একটি ছোট বা ক্ষুদ্র সংস্থার গায়ে রুগ্ণ সংস্থার তকমা লাগানো হবে, সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট নীতি নেই। বড় শিল্পের ক্ষেত্রে কিন্তু বিষয়টি অনেক স্বচ্ছ। তা ছাড়া, রুগ্ণ বড় শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য বিআইএফআর-এর মতো কর্তৃপক্ষ রয়েছে। কিন্তু এ ধরনের সুযোগ থেকেও ব্রাত্য ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প। সমীক্ষার ফল হাতে এলে, এই সব সমস্যার সমাধান করতে সুবিধা হবে বলেও দফতর সূত্রে দাবি।
অনুপবাবু জানান, নভেম্বরে সমীক্ষার কাজ শুরু করবে আইএসআই। আগামী মে মাসের মধ্যেই তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। |