সরকারকে রাজনৈতিক আক্রমণের পাশাপাশি এ বার সাধারণ মানুষের জীবনের দৈনন্দিন সমস্যা নিয়েও সরব হলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
রাস্তাঘাটের করুণ হাল থেকে পাট চাষিদের ফসলের দাম না-পাওয়া, কিছুই বাদ গেল না। মুর্শিদাবাদ জেলা বামফ্রন্টের সমাবেশে বহরমপুরে এসে বৃহস্পতিবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “রাস্তাঘাটের যা অবস্থা, গাড়ি চলতে পারে না। রাস্তা ভেঙেচুরে বসে গিয়েছে। পুকুর হয়ে গিয়েছে! রাস্তায় মাছ চাষ করা যাবে! কে সারাবে, কবে সারাবে, কেউ জানে না!” বুদ্ধবাবুর আরও অভিযোগ, “সব জেলাতেই একই অবস্থা!”
জেলা বামফ্রন্টের সমাবেশে দল তথা ফ্রন্টের নির্বাচনী বিপর্যয়ের জন্য প্রত্যাশিত ভাবে বুদ্ধবাবুর প্রবল আত্মসমালোচনাও ছিল। নিত্য যন্ত্রণায় ভুক্তভোগী আম জনতার প্রশ্ন, রাস্তাঘাটের হাল নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগেও কি আত্মসমালোচনাই ছিল? কারণ, ৪ মাস আগেও তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারই রাজ্যের মসনদে ছিল! রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের হাল নতুন সরকারের চার মাসে যদি করুণতর হয়ে থাকে, তা হলে তার সূত্রপাত বাম আমলেই! |
বস্তুত, কলকাতা থেকে জাতীয় সড়ক ধরে বহরমপুর যাত্রা (যে পথে এ দিন বুদ্ধবাবুও গিয়েছেন) বেশির ভাগ সময়েই খন্দময়। এই পথেই সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে এক বার গুরুতর জখম হতে হয়েছিল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে। সরকারে থাকাকালীন বামফ্রন্ট যে যুক্তি দিত, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ইদানীং তা-ই বলছেন। জাতীয় সড়কগুলির জন্য জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ (এনএইচএআই) আছে। সেখানে রাজ্যের বিশেষ কিছু করণীয় নেই। রাজ্যের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা অবশ্য পূর্ত দফতরের দায়িত্বেও আছে। কলকাতায় পূর্তমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের পাশে বসে বুধবারই কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, বর্ষায় রাস্তা সারাইয়ের জন্য বিটুমিন অপচয়ের কোনও অর্থ হয় না। প্রকৃতপক্ষে, সরকারের যুক্তি এটাই। বর্ষা বিদায় না-নিলে রাস্তা সারানো অর্থহীন। আর উল্টো দিকে, সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা, রোজই বৃষ্টিতে রাস্তার খানা-খন্দ পুকুরের আকার নিচ্ছে। যাতায়াত হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। যে সুর ঘটনাচক্রে এ দিন ধরা পড়েছে খোদ প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর গলায়।
রাস্তা নিয়ে যেমন, গাড়ি চলার রসদ পেট্রোল-ডিজেলের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও তেমনই সরব হন বুদ্ধবাবু। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণববাবুর জেলায় দাঁড়িয়ে তাঁকে এক হাত নেন। বুদ্ধবাবুর কথায়, “প্রণববাবু আবার মজার কথা বলেন! পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লেই তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়াইনি। ও সব কোম্পানিগুলো করেছে।’ আরে, কোম্পানি তো আপনাদেরই! আমরা বলি, সরকার নিয়ন্ত্রণ করুক। ওঁরা বলছেন, না। ওঁরা বিনিয়ন্ত্রণের কথা বলছেন।”
কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্য সরকারের সমালোচনাও ছিল বুদ্ধবাবুর বক্তব্যে। তিনি বলেন, “হঠাৎ একটা বন্যা হয়ে গেল ৩-৪টে জেলায়। কোনও মন্ত্রী গেলেন না! কারও চাষ হল, নাকি হল না, কেউ খোঁজ নিলেন না। আগে এ রকম হত না। এখন বন্যা হচ্ছে কিন্তু সরকার কী করছে, বোঝা যাচ্ছে না!” স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে বন্যা-কবলিত হাওড়া জেলায় গিয়েছিলেন, সমালোচনা করতে গিয়ে এ দিন কিন্তু সেই তথ্য উল্লেখই করেননি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী! বহরমপুর এফএউসি মাঠে গোটা সমাবেশে মমতার নামই অবশ্য এক বারও মুখে আনেননি বুদ্ধবাবু। সমাবেশে ছিলেন প্রাক্তন পঞ্চায়েত মন্ত্রী আনিসুর রহমান, সিপিএম, আরএসপি এবং ফরওয়ার্ড ব্লকের জেলা সম্পাদক যথাক্রমে নৃপেন চৌধুরী, বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভাস চক্রবর্তী প্রমুখ।
বুদ্ধবাবুর অভিযোগ, “কলেজ শিক্ষকেরা মাইনে পাচ্ছেন না। কিন্তু কারও কোনও চিন্তা নেই!” তাঁর প্রশ্ন, তাঁর সরকার বহরমপুরে মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেওয়ার পরেও কাজ হল না কেন? তাঁর বক্তব্য, “গত বার পাটের দাম কুইন্টাল প্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে চার হাজার টাকা হয়েছিল। এ বার এক কুইন্টাল পাটের দাম দু’হাজার টাকা পর্যন্তই উঠছে না। কে মন্ত্রী? কে চিন্তা করছে? কেউ জানে না!” রাজনৈতিক আত্মসমালোচনার কথা প্রত্যাশিত ভাবেই ফের বলেছেন। বলেছেন, বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ১ কোটি ৯৫ লক্ষ ভোট পেয়েছে, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় ৭টি আসন পেয়েছে এগুলি তাঁদের পক্ষে স্বস্তির কথা। সেই সঙ্গেই বলেছেন, “আমাদের কী ভুল হয়েছে, খুঁজে বার করছি। তার পরে যাঁরা পাল্টে দাও বললেন, তাঁদের কাছে যেতে হবে। কেন তাঁরা ওই সিদ্ধান্ত নিলেন, জানতে হবে। ওই মানুষের কাছেই আমরা মাথা নিচু করে যাচ্ছি।” তবু এ দিন বুদ্ধবাবুর মূল সুর ছিল আম জনতার জীবনের দৈনন্দিন সমস্যাই। তাই এই বিষয়ে আন্দোলনের প্রশ্নে তাঁর ঘোষণা, “এর বিরুদ্ধে আমরা ছাড়া কে আছে আর? যত দূর যেতে হয়, যাব!” |