|
|
|
|
|
পালে কংগ্রেস হাওয়া,
‘পরিবর্তনের’ স্বপ্নে তৃণমূল
সন্দীপন চক্রবর্তী • কলকাতা |
|
জাফরপুর জামে মসজিদের কাছে স্কুলমাঠে ম্যারাপ বাঁধা তখনও শেষ হয়নি। একটু পরেই জনসভা করতে এসে পড়বেন তৃণমূলের দুই তারকা বিধায়ক চিরঞ্জিৎ ও সাংসদ শতাব্দী রায়। তারকাদের গঞ্জে আগমন নিয়ে অত্যুৎসাহী সমর্থককুল। এতটাই যে, ম্যারাপটা বাঁধা হয়নি, খেয়াল হল অনেক পরে!
মাঠের লাগোয়া রাস্তার দু’ধারে তৃণমূলের মুখোমুখি দু’টি নির্বাচনী কার্যালয়। দুপুর বেলার ভিড় দুই ঘরেই দেদার হিন্দি ছবি দেখছে। ভোট সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নের উত্তর নেই। প্রশ্নকর্তার দিকে এক বার তাকিয়েই চোখ সরে যাচ্ছে টিভির পর্দায়। জটলার মধ্যেই গাড়ি থেকে নামলেন চল্লিশ বছরের এক যুবা। ভিড় পথ আগলে দাঁড়িয়ে। যুবার সঙ্গীরা বললেন, “যেতে দিন, যেতে দিন! উনিই তো প্রার্থী!”
জনসভার ম্যারাপ সময়ে বাঁধা হয় না। প্রচারের সময় নির্বাচনী কার্যালয়ে সিনেমা চলে। তবু ‘স্বস্তিতেই’ আছেন তৃণমূল প্রার্থী আবু তাহের মহম্মদ (এ টি এম) আবদুল্লা! রনি নামেই এলাকা যাঁকে চেনে। তাঁর পরিষ্কার কথা, “অবিভক্ত বসিরহাটে ৩৪ বছর ধরে সিপিএমের এক জনই বিধায়ক (এ বার বসিরহাট দক্ষিণ থেকে জয়ী নারায়ণ মুখোপাধ্যায়) ছিলেন। যে হাসনাবাদের কিছু এলাকা এই কেন্দ্রে এসেছে, সেখানকারও দীর্ঘ দিন বিধায়ক ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী গৌতম দেব। চার মাস আগে রাজ্যে পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বসিরহাটে পরিবর্তনটা হয়নি। এ বার মানুষের সামনে সেই সুযোগ!”
কয়েক কিলোমিটার দূরে মাটিয়া বাজারে খানিক পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর দুই সদস্য গৌতমবাবু এবং মহম্মদ সেলিমের সভামঞ্চের পাশ দিয়ে ম্যাটাডোর-বোঝাই তৃণমূল সমর্থকদের চিরঞ্জিৎ-শতাব্দী দেখতে যাওয়া দেখতে দেখতে সুবিদ আলি গাজী বললেন, “এই কেন্দ্রের অন্তর্গত ১৩টা গ্রাম পঞ্চায়েতই কংগ্রেস-তৃণমূলের। শুধু দুর্নীতি আর মারামারি। রাস্তার অবস্থা (টাকি রোড, হাড়োয়া রোড) দেখুন! নায়ক-নায়িকা নাচিয়ে কী হবে? রাস্তাই তো সব্বাইকে নাচিয়ে দিচ্ছে!” জবাবটা আগেই দেওয়া ছিল আবদুল্লার “এত বছর একই দলের বিধায়ক থেকেও উন্নয়ন হল না!” প্রাক্তন শিক্ষক এবং হাসনাবাদ পঞ্চায়েত সমিতির প্রাক্তন সভাপতি, সিপিএম প্রার্থী সুবিদ তবু আশাবাদী, পঞ্চায়েতে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের ‘অপকর্ম’ই বসিরহাট উত্তর বিধানসভা কেন্দ্র তাঁদের দখলে রেখে দিতে অনেকটা সাহায্য করবে।
যে জোটের পঞ্চায়েতের কথা সুবিদ বলছিলেন, প্রকৃতপক্ষে সেই জোটই আবদুল্লার ‘তুরুপের তাস’। বসিরহাট-২ ব্লকের ৯টি এবং হাসনাবাদের ৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে একটিতে তৃণমূল একক ভাবে ক্ষমতায়। বাকিগুলিতে কংগ্রেসের দাপট বেশি। এলাকায় সংগঠন বলতেও কংগ্রেস। বসিরহাট-২ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সিরাজুল ইসলাম এবং ঘোড়ারস-কুলীনগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সিরাজুল ইসলাম কংগ্রেসের দুই সিরাজুলই ঘাসফুল প্রতীকের প্রার্থীর জন্য ময়দানে কোমর বেঁধে নেমেছেন। যে ছবি কয়েক মাস আগের বিধানসভা ভোটে ছিল না। আরও তাৎপর্যপূর্ণ, তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার আগে পর্যন্ত আবদুল্লা নিজেই ছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী বসিরহাট-২ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি! তৃণমূলের প্রার্থী হওয়ার পরে কংগ্রেস ছেড়েছেন। ‘নৈতিকতা’র কারণে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যপদেও ইস্তফা দিয়েছেন। আবদুল্লার পাশে থেকে যুব কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি আব্দুল হান্নান মোল্লা বা পঞ্চায়েত সদস্য মুজফ্ফর খানের মতো কংগ্রেস নেতা-কর্মীরাই তাঁদের ‘রনিদা’কে ভোট বৈতরণী পার করানোর হাল ধরেছেন। তাতে তৃণমূলের একাংশের কিঞ্চিৎ ক্ষোভ আছে ঠিকই। কিন্তু তা যতটা বসিরহাটের তৃণমূল সাংসদ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে, অন্য কোনও প্রশ্নে ততটা নয়।
আবদুল্লার নিজের কথায়, “বসিরহাট কলেজে ছাত্র সাংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ছাত্র পরিষদের হয়ে। ১৯৯৮ সালে তৃণমূলে গিয়ে জেলা পরিষদের প্রার্থী হয়েছি। ২০০৩ সাল থেকে আবার কংগ্রেসে। তাদের প্রার্থী হিসাবেই পঞ্চায়েত সমিতিতে জিতেছি। এখন আবার দিদির ডাকে তৃণমূলে ফিরেছি।” এত লোক থাকতে ‘দিদির ডাক’ কেন কংগ্রেসের এক জনের কাছেই পৌঁছল? তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক মুকুল রায়ের জবাব, “ও তো আমাদেরই ছেলে ছিল আগে! এখন ওই কেন্দ্রটায় আমাদের জয় শুধু সময়ের অপেক্ষা!” তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পর্যবেক্ষক এবং রাজ্যের মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ব্যাখ্যা আরও প্রাঞ্জল, “বসিরহাটের বাইরে থেকে প্রার্থী করে আগে একটু সমস্যা হয়েছিল। এ বার বসিরহাটের ছেলেকে আসনটা দিয়েছি আমরা। দল ছাড়াও এলাকায় রনির একটা সামাজিক পরিচিতি আছে। সেটা খুব কাজে লাগবে!”
এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, জ্যোতিপ্রিয়ের ব্যাখ্যা ‘ঠিক’। আর কংগ্রেসের ‘ঠিক লোক’ তৃণমূলে এলে ‘সম্মান’ পাবেন, এই ‘বার্তা’ও তৃণমূল নেতৃত্ব আবদুল্লাকে প্রার্থী করেই কৌশলে ভাসিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেস তাই এই অকাল শারদীয় ভোটে রাজ্যের বড় শরিকের পাশেই।
অকাল ভোট যখন, বসিরহাট উত্তরে গত বার জয়ী সিপিএম বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের অকাল মৃত্যুর ছায়া থাকবে না এ হয় না। সুবিদ প্রচারে মোস্তাফাকে স্মরণ করছেন, তাঁর স্ত্রীর ‘দোয়া’ নিয়ে আসার কথা বলছেন। আবদুল্লার বাড়ি ধান্যকুড়িয়ায় মোস্তাফার গ্রাম নেয়ালপুরেই। তিনিও মোস্তাফার বাড়ি গিয়ে ওই পরিবারের ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে আসতে কুণ্ঠা করবেন না, তা-ও স্বাভাবিক।
কংগ্রেসের ‘ভরসা’র পাশাপাশিই অঙ্কের হিসাবও আবদুল্লার দিকে ঝুঁকে। লোকসভায় এই কেন্দ্রে জোটপ্রার্থীর ‘লিড’ ছিল ১৭ হাজার ৩১০ ভোটের। বিধানসভায় মোস্তাফা জেতেন ৩ হাজার ৯৪৩ ভোটে। সে বার বিজেপি ৯ হাজার ও সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীর পিডিসিআই ৭ হাজার ভোট কেটে নিয়েছিল। এ বার সিদ্দিকুল্লার প্রার্থীই নেই! আর বিজেপি-র প্রার্থী থেকেও ‘রহস্যজনক’ ভাবে ম্রিয়মান!
আবার উল্টো দিকে, বসিরহাট উত্তর কেন্দ্রের ১ লক্ষ ৯২ হাজার ভোটারের মধ্যে ৬৫% মুসলিম এবং তাঁদের অধিকাংশই বস্ত্রশিল্পের কারিগর। বস্ত্রশিল্পে কেন্দ্রীয় সরকার যে কর বসিয়েছিল, বিধানসভা ভোটের আগে এক জনসভা থেকে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে তা তুলে নেওয়ার কথা বলেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কর আজও ওঠেনি। বরং সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যে চুক্তি করে এসেছেন, তাতে সীমান্তপারের রেডিমেড পোশাক কর ছাড়াই আমদানি হয়ে আসবে এ’পারে। তাতে এ বাংলার কারিগরগের জীবিকা বিপন্ন হবে, এই প্রচার চালানোর সুযোগ পাচ্ছে সিপিএম।
সিপিএমের তরফে প্রচারের মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত গৌতমবাবু বলছেন, “আমরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। আর এখন এই সরকার ৩৪ সপ্তাহও পেরোয়নি! এই সরকারের ভুল ধরার মধ্যে বিরাট বাহাদুরি নেই! কিন্তু মমতা যখন বলছেন দলের নাম করে কেউ টাকা চাইলে দেবেন না, তার সঙ্গে বসিরহাটের মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখবেন। সুন্দরবন এলাকায় শুধু কতগুলো সেতু বামফ্রন্ট করেছিল, ভাববেন। জমি থেকে এখন কারা কৃষকদের উচ্ছেদ করছে, দেখবেন। দেখেই ভোটটা দেবেন।” প্রার্থী সুবিদ বলছেন, “সরকার যে ভাবে কাজ করছে, তার বিরুদ্ধে একটা কড়া সঙ্কেত পাঠাতেই এই ভোট।”
ভেবিয়া, মুরারিশা, গোপালপুর, ঘোড়ারস, মাটিয়া, রাজেন্দ্রপুরের তারকা-প্রত্যাশী মানুষের কাছে হক কথাটা অবশ্য বলেছেন চিরঞ্জিতই “গল্পটা জানেন তো! রাজার পুকুরে দুধ ঢালতে বলায় কেউ কেউ ভেবেছিল, সবাই তো দুধ ঢালবে। আমরা জলই ঢালি! সেই ভুলটা করবেন না। ভোটটা নষ্ট করবেন না!” |
|
|
|
|
|