কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের হিংসাত্মক তৎপরতা আবার নূতন করিয়া মাথা চাড়া দিয়াছে। এই তৎপরতা চলিতেছে তখন, যখন রাজ্য সরকারের সবুজ সঙ্কেত পাইয়া মধ্যস্থতাকারীদের একটি দল মাওবাদীদের সহিত আলোচনা চালাইতেছে। ইহা দুর্ভাগ্যজনক। আলোচনার প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ করিতে গেলে হিংসাশ্রয়ী ক্রিয়াকলাপ হইতে নিরস্ত হওয়া আশু প্রয়োজন। রাজ্যের বিরোধী নেতা যেমন বলিয়াছেন আস্তিনের তলায় অস্ত্র লুকাইয়া কোনও আলোচনা হয় না। বাস্তবিকই হয় না। যে কোনও আপস-প্রক্রিয়ার পূর্বশর্তই হইল দুই পক্ষের মধ্যে এই পারস্পরিক আস্থা যে, আলোচনা চলা-কালে কোনও পক্ষই অন্যকে আঘাত করিবে না। মাওবাদীরা কিন্তু সেই বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিতেছে না। আলোচনার প্রক্রিয়া চালু থাকার মধ্যেই তাহারা কিংবা তাহাদের সমর্থকরা শাসক দলের দুই-দুইজন স্থানীয় নেতাকে কয়েক দিনের ব্যবধানে হত্যা করিয়া মৃতদেহের পাশে হত্যার কারণ ব্যাখ্যা করিয়া পোস্টার ছড়াইয়াছে। ইহা আলোচনার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাতেরই শামিল।
অথচ শাসনপ্রণালীতে নির্বাচনোত্তর পরিবর্তনের পর রাজ্য সরকার মাওবাদীদের প্রতি নমনীয় অবস্থানই গ্রহণ করিয়াছিল। জঙ্গলমহলে অনুন্নয়নের সমস্যাগুলি শনাক্ত করিয়া সেগুলি মীমাংসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু ব্যবস্থাগ্রহণের সদিচ্ছা যেমন রাজ্যের তরফে দেখা যায়, মাওবাদীদের তরফে তাহাতে কোনও অনুকূল সাড়া মেলে নাই। রাজ্য যৌথ বাহিনীর অভিযান কার্যত স্থগিত রাখিয়াছিল, মূল স্রোতে ফিরিতে ইচ্ছুকদের পুনর্বাসনের প্যাকেজও ঘোষণা করিয়াছিল। সেই সঙ্গে তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগও, ইতিপূর্বে কেহ যাহা দেয় নাই। এ জন্য অস্ত্রসমর্পণ কিংবা আত্মসমর্পণের ডাক দেওয়া হয় নাই। কেবল হিংসা বন্ধের আবেদন জানানো হয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমও কলিকাতায় একটি বণিকসভার অনুষ্ঠানে মাওবাদীদের উদ্দেশে আলোচনায় বসার আবেদন পুনরুচ্চারণ করিয়াছেন। সেখানেও মতাদর্শ, সংগঠন, আগ্নেয়াস্ত্র কিছুই বিসর্জন দিতে বলা হয় নাই। কেবল হিংসা হইতে নিবৃত্ত হইতে বলা হয়। সরকারের তরফে এমন নিঃশর্ত আপস-আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হইলেও মাওবাদীরা কিন্তু রকমারি শর্ত আরোপ করিতেছে। যৌথবাহিনী প্রত্যাহার করিতে হইবে, জঙ্গলমহলে পুলিশি নজরদারি বন্ধ রাখিতে হইবে, মাওবাদীদের যথেচ্ছ ঘোরাফেরা করিতে দিতে হইবে। দেখিয়া-শুনিয়া মনে হয় না, আলোচনার টেবিলে বসিতে মাওবাদীরা সত্যই ইচ্ছুক। যদি সমস্যা সমাধানের সদিচ্ছা অপেক্ষা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি অটুট রাখাই বেশি অভিপ্রেত হয়, তবে আলোচনায় ফল হইবে কেমন করিয়া?
সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক যে, মাওবাদীরা বোধহয় সমাধানে তত আগ্রহী নয়। বরং আলোচনা-প্রক্রিয়া চালু রাখার অন্তরালে নিজেদের ছত্রভঙ্গ শক্তিকে পুনর্বিন্যস্ত ও সংহত করিয়া লইতেই অধিকতর উৎসুক। শ্রীলঙ্কার মতো দেশে দেখা গিয়াছে, এল টি টি ই-র মতো জঙ্গি সন্ত্রাসীরা সরকারের সহিত সংঘর্ষ-বিরতি ও আপস-আলোচনার কালক্ষেপকারী প্রক্রিয়ার অবকাশে নিজেদের সাংগঠনিক সংহতি গুছাইয়া লইতে তৎপর হইয়াছে। জঙ্গলমহলে তাহা করার জন্য যৌথ বাহিনীর অভিযান বা পুলিশের টহলদারি বন্ধ হওয়া দরকার। অথচ গণতন্ত্রে কোনও নির্বাচিত সরকারের পক্ষে জনসাধারণের নিরাপত্তার দায় এ ভাবে ঝাড়িয়া ফেলা সম্ভব নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায় হইতে সরকার হাত ধুইয়া ফেলিতে পারে না। মাওবাদীরা যাহা চাহিতেছে, তাহা মঞ্জুর করার অর্থ কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ন্যূনতম দায়িত্বও পালন না করা। দুনিয়ার কোনও সরকারের পক্ষে এই শর্ত মানিয়া লওয়া সম্ভব নয়। |