সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তা
চিদম্বরমের পাশেই দাঁড়ালেন মনমোহন
টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টন নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক সত্ত্বেও পালানিয়াপ্পন চিদম্বরমের প্রতি ‘আস্থা অটুট’ মনমোহন সিংহের।
আজ ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে নিউ ইয়র্ক যাওয়ার পথে বিমানে খানিকটা প্রথা ভেঙেই সাংবাদিকদের কাছে আসেন প্রধানমন্ত্রী। তখন স্বাভাবিক ভাবেই তথ্য জানার অধিকারে প্রকাশ্যে আসা অর্থ মন্ত্রকের নোট নিয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। যে নোটে টু-জি স্পেকট্রাম বণ্টনে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। গত ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের যুগ্মসচিবকে লেখা অর্থ মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টরের নোটে বলা হয়েছে, চিদম্বরম চাইলে স্পেকট্রাম নিলাম না করার সিদ্ধান্ত ঠেকাতেই পারতেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আপনারা কোন নোটের কথা বলছেন আমি জানি না। তবে যে বিষয়ে বলা হচ্ছে, সেটি বিচারাধীন। ফলে এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। আর চিদম্বরম প্রসঙ্গে বলা হল, অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি আমার পূর্ণ আস্থাভাজন ছিলেন। আর এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও তাঁর প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা পেয়ে থাকেন।”
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরে প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থার অভাব ঘটছে মনমোহনের। বিশেষ করে মনমোহনকে আজ ফোনে যখন প্রণববাবুর বিরুদ্ধে চিদম্বরম বিস্তর অভিযোগ করেছেন বলে খবর। সূত্রের বক্তব্য, চিদম্বরমের ধারণা, প্রণববাবুর জ্ঞাতসারেই এই নোটের খবর পাচার হয়েছে। তা না হলে বিজেপি-র তথ্য জানার অধিকার সেলের প্রধান বিবেক গর্গ ওই নোট সম্পর্কে জানতে চাইলেন কেন? বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী নিজেও গত কাল ঘনিষ্ঠ মহলে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সরকারের ভিতর থেকে খবর না গেলে এই অভ্যন্তরীণ নোটের কথা বাইরের লোক জানল কী করে!
তার উপর কংগ্রেসও আজ চিদম্বরমের পাশে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী সলমন খুরশিদ বলেন, “সব কাগজপত্র দেখার পর দায়িত্ব নিয়ে বলছি যে, চিদম্বরমের বিরুদ্ধে কোনও নেতিবাচক প্রশ্নই উঠতে পারে না।” কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক মনু সিঙ্ঘভিও বলেন, “চিদম্বরমের সততা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। নিলাম না ডেকে স্পেকট্রাম বণ্টনের সিদ্ধান্তের জন্য কোনও ভাবেই তাঁকে দায়ী করা যায় না। তা ছাড়া, চিদম্বরম যে স্পেকট্রাম বণ্টনের জন্য দায়ী ছিলেন না, সে ব্যাপারে প্রণব মুখোপাধ্যায়ও বিভিন্ন সময়ে মন্তব্য করেছিলেন।”
প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের মুখপাত্রের অবশ্য ব্যাখ্যা, চিদম্বরমকে সমর্থন করার অর্থ মোটেই প্রণববাবুর প্রতি অনাস্থা নয়। এখন চিদম্বরমের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের দাবি জানাচ্ছে। তাঁর ইস্তফা চাওয়া হচ্ছে, না হলে তাঁকে বরখাস্ত করার কথা বলা হচ্ছে। ফলে এখন চিদম্বরমের সমর্থনে এগিয়ে আসাই স্বাভাবিক। আর এই নোটের মধ্যে দিয়ে সরকারের দুই শীর্ষ মন্ত্রীর মতবিরোধের যে কথা উঠে আসছে, তা-ও ঠিক নয় বলে তাঁর দাবি। মুখপাত্রের বক্তব্য, নীতি নির্ধারণের সময় বিভিন্ন মন্ত্রী বিভিন্ন মত দিতেই পারেন। তাতে দুর্নীতি প্রমাণ হয় না। নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে তো মামলা চলছে। অভিযুক্তেরা জেলেও গিয়েছেন।
তাঁকে ঘিরে টু জি বিতর্ক যখন সরগরম, তখন ভূমিকম্প-পরিস্থিতি দেখতে
গ্যাংটকে চিদম্বরম। হেলিপ্যাডে পবন চামলিঙের সঙ্গে। ছবি: সন্দীপ পাল।
এই সাফাই সত্ত্বেও কংগ্রেস সূত্রে কিন্তু বলা হচ্ছে, গোটা ঘটনায় প্রণববাবু এখন কিঞ্চিৎ কোণঠাসা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী আজ নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটনে গিয়েছেন। নিউ ইয়র্কে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গেও মনমোহনের কথা হয়েছে। তার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রণববাবু বলেন, “তথ্য জানার অধিকার আইনের মাধ্যমে একটা চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশ্যে এসেছে। অর্থ মন্ত্রক থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি নোট পাঠানো হয়েছিল। কেউ এক জন তথ্য জানার অধিকার আইনে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কাছ থেকে বিষয়টি জানতে চান। একটি মামলায় সেটিকে প্রমাণ হিসেবে পেশও করা হয়েছে। ফলে বিষয়টি বিচারাধীন। অতএব এ নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে পারি না।” বিজেপি-র বক্তব্য, এই মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তাঁর মন্ত্রক যে নোটটি পাঠিয়েছিল এবং সে ব্যাপারে তাঁর সায় ছিল, সে কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন প্রণববাবু।
সব মিলিয়ে গোটা ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তিই প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে গেল বলে বিরোধীদের দাবি। এবং প্রকাশ্যে সেই দাবি খারিজ করলেও একান্ত আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা কবুল করছেন যে, সেটা তাঁদেরও মাথাব্যথা। একের পর এক দুর্নীতি, অণ্ণা হজারে কাণ্ডের পরে এই ‘ধাক্কা’ কী ভাবে সামলানো যাবে, সেটাই আশু চিন্তা। কারণ, শুধু দলে নয়, সরকারের ভিতরের চিড়ও স্পষ্ট করেছে অর্থ মন্ত্রকের নোট। টু-জি কেলেঙ্কারিতে অভিযোগের তির যাঁর দিকে, সেই জেলবন্দি এ রাজার দল সরকারের শরিক ডিএমকে আজ বলছে, এই নোট থেকেই একের পর এক দুর্নীতি, অণ্ণা হজারে কাণ্ডের পরে এই ‘ধাক্কা’ কী ভাবে সামলানো যাবে, সেটাই আশু চিন্তা। কারণ, শুধু দলে নয়, সরকারের ভিতরের চিড়ও স্পষ্ট করেছে অর্থ মন্ত্রকের নোট। টু-জি কেলেঙ্কারিতে অভিযোগের তির যাঁর দিকে, সেই জেলবন্দি এ রাজার দল সরকারের শরিক ডিএমকে আজ বলছে, এই নোট থেকেই প্রমাণ হয়ে গেল যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা কিছু করেননি। স্পেকট্রাম নিলাম না করে ‘আগে এলে আগে পাবে’র ভিত্তিতে বণ্টনের বিষয়টি সকলেই জানতেন।
চিদম্বরম এবং প্রণববাবুর রেষারেষি নিয়ে সরকার তথা কংগ্রেসের অন্দরে জল্পনা ছিলই। এর আগে অর্থ মন্ত্রকে চরবৃত্তির অভিযোগ ঘিরে দু’জনের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছিল। আর এ বারের ঘটনা কংগ্রেসের অপূরণীয় রাজনৈতিক ক্ষতি করে দিয়ে গেল বলে দলের অনেক শীর্ষ স্তরের নেতাই মেনে নিচ্ছেন।
এই অবস্থায় তিনি দেশে না ফেরা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে মুখ বন্ধ রাখারই পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ভূকম্প বিধ্বস্ত সিকিম পরিদর্শনে যাওয়া চিদম্বরম আজ সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি, তিনি দেশে ফেরা না পর্যন্ত আমি এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলব না।”
প্রণববাবু দেশে ফিরবেন ২৬ তারিখ। প্রধানমন্ত্রী ২৭শে। কংগ্রেসের এক নেতার কথায়, “দল ও সরকারের শীর্ষ চার মাথা (সনিয়া-সহ) এক না হলে মুশকিল আসান যে সম্ভব নয়, তা স্পষ্ট। কিন্তু এটাও পরিষ্কার যে, তত ক্ষণে রাজনৈতিক ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যাবে।”
সেই ক্ষতি যতটা সম্ভব সামাল দেওয়ার চেষ্টা অবশ্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে সংশ্লিষ্ট মামলার শুনানি আজ ২৭ তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছে। সরকারের অবস্থান জোরালো ভাবে তুলে ধরার ভার সলমনকে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সিবিআই-এর তরফেও আজ আদালতে বলা হয়েছে, কম দামে স্পেকট্রাম বণ্টনের জন্য চিদম্বরম দায়ী নন। প্রাক্তন অর্থসচিব তথা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান গভর্নর সুব্বরাওয়ের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে বলা যায় যে, চিদম্বরমের নেতৃত্বে (২০০৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত) অর্থ মন্ত্রক কোনও ভাবেই কম দামে স্পেকট্রাম বণ্টনের জন্য দায়ী ছিল না। বরং অর্থ মন্ত্রক নিলাম করার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু টেলিকম দফতর নিলাম না করার ব্যাপারে অনড় ছিল।
তবে এটা নিছকই সিবিআই-এর যুক্তি। শেষ পর্যন্ত আদালত চিদম্বরমের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিলে যে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও তীব্র হবে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “চিদম্বরমের বিরুদ্ধে যদিও আইনগত ভাবে বিশেষ কিছু ব্যবস্থার আশঙ্কা নেই। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে স্পেকট্রাম বণ্টনের জন্য কোনও ষড়যন্ত্রের প্রমাণ নেই। বড় জোর নীতিগত ভাবে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার অভিযোগ উঠতে পারে। যা ফৌজদারি অপরাধ নয়।” তবে আইনত কিছু না হলেও শীর্ষ আদালত তদন্তের নির্দেশ দিলে যে রাজনৈতিক ভাবে প্রবল ক্ষতি হবে, সে কথা মানছেন কংগ্রেসের অনেকেই।

সহ প্রতিবেদন: শঙ্খদীপ দাস


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.