যে মনমোহন সিংহ মিশরের শর্ম-অল-শেখে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে শান্তির পায়রা উড়িয়েছিলেন, আজ দু’বছর পরে নিউ ইয়র্কে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে এসে সেই মনমোহন সিংহ যেন বদলে গিয়েছেন।
এ বার যেন এক অন্য মনমোহনকে দেখা যাচ্ছে। যে মনমোহন শান্তিপ্রক্রিয়ায় হতাশ হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে চাইছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনের পর মলদ্বীপের রাজধানী মালেতে সার্ক সম্মেলনের আগে পাকিস্তানকে চাপে রাখাটাই যে মনমোহন সিংহের উদ্দেশ্য। এর আগে লাহৌর বাসযাত্রা করে শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করে কার্গিলে এসে ধাক্কা খেয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। এ বারও মুম্বইয়ের ধারাবাহিক বিস্ফোরণের পর দিল্লিতে বিস্ফোরণ হয়েছে। জাতীয় রাজনীতি উত্তাল। কূটনীতির বড় চিত্রের দিকে তাকিয়ে একদা যে মনমোহন পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্কে বিশ্বাস করতেন, আলোচনা প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার যুক্তিতে সওয়াল করতেন, এ বার যেন তিনি এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতেই বেশি উৎসাহী। |
রাষ্ট্রপুঞ্জে অধিবেশনের কয়েক দিন আগে আফগানিস্তানে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বুরহানুদ্দিন রব্বানিকে যে ভাবে হত্যা করা হল, তার ছায়া এসে পড়েছে নিউ ইয়র্ক শহরেও। রব্বানির হত্যার পিছনে পাকিস্তানের ‘হাত’ দেখছে ভারত। এবং মনে করছে, পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও আমেরিকা যথেষ্ট তৎপরতা দেখাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের তরফে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাস নিয়ে দু’রকম অবস্থান চলতে পারে না। আমেরিকাকে ভারত তাই বার্তা দিতে চাইছে, ‘ভাল সন্ত্রাসবাদী, খারাপ সন্ত্রাসবাদী’ বা ‘তোমাদের সন্ত্রাসবাদী, আমাদের সন্ত্রাসবাদী’-র এই ভেদাভেদ যেন করা না হয়। শনিবার রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ সন্ত্রাস-বিরোধী বক্তব্যে এই যুক্তিই তুলে ধরবেন।
আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এর মধ্যেই মনমোহনকে জানিয়েছেন, আগামী মাসের গোড়াতেই তিনি নয়াদিল্লি আসছেন। কারণ, রব্বানি হত্যার পরে সন্ত্রাস মোকাবিলায় নতুন ‘নীল নকশা’ তৈরি করতে চাইছে নয়াদিল্লি-কাবুল।
প্রেসিডেন্ট কারজাই তালিবানের সঙ্গে সমঝোতার দায়িত্ব দিয়েছিলেন রব্বানিকে। সেই লক্ষ্যে কারজাই যে ‘শান্তি পরিষদ’ গঠন করেছিলেন, রব্বানি ছিলেন তার চেয়ারম্যান। গত জুলাইয়ে রব্বানি দিল্লি এসে মনমোহনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই রব্বানিকে হত্যার পিছনে আল কায়দা ঘনিষ্ঠ যে ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’-এর হাত রয়েছে, তারা পাকিস্তানের মদতে চলে বলেই মনে করছে ভারত। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন বা বিদেশসচিব রঞ্জন মাথাই-রা মনে করছেন, এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই নিয়ে গত তিন মাসে আফগান-সরকারের তিন জন প্রতিনিধিকে হত্যা করা হল। প্রথমে কারজাইয়েরই ভাই আহমেদ আলি কারজাই, তার পরে প্রাক্তন গভর্নর জান মহম্মদ খান। শেষে খুন হলেন রব্বানি। আজকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রে বলা হচ্ছে, এর পরে হামিদ কারজাই ছাড়া কাবুলের আর কোনও শীর্ষ নেতাই রইলেন না।
বলা হচ্ছে, এর পর কারজাই ছাড়া কাবুলের আর কোনও শীর্ষ নেতাই রইলেন না।
আজ অবশ্য ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ নিয়ে সরব হল মার্কিন প্রশাসন। রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনের আগে এই ঘটনাকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। মার্কিন সেনাপ্রধান অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন এ দিন সেনেটের সামনে যা বলেছেন, তার নির্যাস হল, হাক্কানি নেটওয়ার্ক পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সহযোগী এবং তাদের মদতেই কাজ করে। এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি কাবুলের মার্কিন দূতাবাসও। পাকিস্তান সঙ্গে সঙ্গে এর বিরোধিতা করেছে। পাক বিদেশমন্ত্রী রেহমান মালিক বলেছেন, হাক্কানিরা যে পাক মাটিতে রয়েছে, আগে তার তথ্যপ্রমাণ দিক আমেরিকা। প্রসঙ্গত, লাদেনের প্রসঙ্গে যখন বারবার একই অভিযোগ উঠত, তখনও পাকিস্তান তা অস্বীকার করে ‘তথ্যপ্রমাণ’ দেওয়ার দাবি তুলত। শেষ পর্যন্ত অবশ্য দেখা গেল, লাদেন পাকিস্তানেই লুকিয়ে ছিলেন। সেই দৃষ্টান্ত তুলে দিল্লি অভিযোগ করছে, এর থেকেই বোঝা যায়, তালিবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা এখনও রয়েছে।
বস্তুত, তালিবান যখন আফগানিস্তানের শাসনকর্তা, তখন থেকেই তাদের সঙ্গে ইসলামাবাদের দহরম মহরম। ৯/১১-এর পর আমেরিকার চাপে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ দেয় পারভেজ মুশারফের প্রশাসন। এখন লাদেন হত্যার ঘটনাকে সামনে রেখে ভারত আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে আমেরিকাকে দেখাতে চাইছে, পাকিস্তান কিন্তু পুরনো পথ ছাড়েনি। ফের তারা আফগানিস্তানের তালিবানিকরণ করছে। এবং এর ফলে ভারতের বিপদ আরও বাড়বে।
নয়াদিল্লির এখন বক্তব্য, শুধু বিবৃতি দিয়ে সন্ত্রাস দমন হবে না। আমেরিকা সন্ত্রাসবাদের শিকার হলে সকলে মিলে যেমন একযোগে তার মোকাবিলা করে, ভারতের বেলাতেও সেটাই করা উচিত। অথচ, আজ ৯/১১ নিয়ে যে রকম প্রচার হচ্ছে, ২৬/১১ নিয়ে সেটা হচ্ছে না। আমেরিকা প্যালেস্তাইনের সন্ত্রাস নিয়ে সরব হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জে প্যালেস্তাইনকে স্থায়ী সদস্য করার প্রস্তাবে তারা সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ তুলে আপত্তি জানাচ্ছে। অথচ কাবুলের ঘটনা নিয়ে তারা একই রকম তৎপরতা দেখাচ্ছে না। তালিবানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান যাতে পাক সেনার সাহায্য পায়, সে জন্য কারজাই-কায়ানির বৈঠক করিয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। পাক সেনাপ্রধান পারভেজ কায়ানিকে আমেরিকাতেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি তাতে কোনও লাভ হয়েছে? আমেরিকার আফ-পাক নীতি নিয়ে হতাশ ভারতের কোনও কোনও মহল থেকে এই প্রশ্নও তোলা হয়েছে। তাই আফগানিস্তান থেকে আমেরিকাকে সেনা প্রত্যাহার করতেই বারণ করছে ভারত।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এ বার রাষ্ট্রপুঞ্জে মনমোহনের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির বৈঠক হচ্ছে না। পাকিস্তানে প্রচণ্ড বন্যা হয়েছে বলে গিলানি আসছেন না। মালেতে সার্কের সম্মেলনের সময় অবশ্য দুই নেতার শীর্ষ বৈঠক হবে। এখানে দু’দেশের বিদেশমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক হতে পারে। সার্কের আগে নভেম্বরে জি-২০ সম্মেলন হবে, সেখানে আবার বারাক ওবামার সঙ্গে মনমোহনের বৈঠক হতে পারে। সেখানেও আমেরিকার আফ-পাক নীতি নিয়ে ভারতের দুশ্চিন্তার কথা ওবামাকে জানানো হবে। মনমোহন এক বার বলেছিলেন, দিল্লিতে প্রাতরাশ সেরে লাহৌরে মধ্যাহ্নভোজন করে, কাবুলে নৈশভোজ করতে চান খুব কম সময়ের মধ্যে ভারতের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহরে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে এই ভাবে পাকিস্তানকে চাপ দেওয়ার পথেই হাঁটতে চাইছে দিল্লি। সেই কাজে কাবুলের ঘটনাকেও হাতিয়ার করা হবে। পাকিস্তানকে এই ভাবে চাপের মধ্যে রাখতে চাইলেও, আসলে কিন্তু মনমোহন অন্য কোনও মনমোহনে পরিণত হননি। প্রধানমন্ত্রীর সফরে শিবশঙ্কর মেনন থেকে শুরু করে রঞ্জন মাথাই, সকলেই একটা জিনিস বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সেটা হল, পাকিস্তানকে সঙ্গে নিতে উৎসাহী ভারত। পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই অঞ্চলে শান্তিপ্রক্রিয়া গড়ে ওঠা কঠিন। কিন্তু তার পাশাপাশি যে ভাবে কাবুলের তালিবানিকরণ হচ্ছে এবং ভারতেও একের পর এক বিস্ফোরণ হচ্ছে, সেখানে পাকিস্তানকে চাপের মধ্যে রাখাও প্রয়োজন বলে মনে করছে নয়াদিল্লি। এই দ্বিমুখী রণকৌশল নিয়েই তাই এগোতে চাইছেন মনমোহন সিংহ। |