পুরুলিয়া শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে রঘুনাথপুর থানার অন্তর্গত তেলকুপি, বর্তমানে দামোদর নদের গর্ভে নিমজ্জিত অতীতের বন্দর-নগরী তৈলকম্প। অনেকের মতে তৈলকম্প থেকেই তেলকুপি নামের উদ্ভব। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত কাব্যে এই তৈলকম্পের উল্লেখ আছে: ‘যুদ্ধে যার প্রভাব নদী পর্বত ও উপান্তভূমি জুড়ে বিস্তৃত, পর্বত কন্দরের রাজবর্গের যিনি দর্পহরণকারী দাবানলের মতো, সেই তৈলকম্পের কল্পতরু রুদ্রশিখর’। রামচরিত-এর বর্ণনাকাল ১০৭০-১১২০ খ্রিস্টাব্দ। কাব্যের মূল বিষয় রামপালের কীর্তিকাহিনির বিবৃতি। কাব্যে উল্লিখিত রুদ্রশিখর যে তৈলকম্পের রাজা ছিলেন তা পুরুলিয়ার বোড়ামে প্রাপ্ত একটি শিলালিপি থেকেও আমরা জানতে পারি। পালসম্রাট রামপালের সঙ্গে যে রুদ্রশিখরের মিত্রতা ছিল ইতিহাসে তার সাক্ষ্য বর্তমান। অতীতে তৈলকম্প রাজ্য পুরুলিয়ার বুকে প্রবাহিত দামোদরের দক্ষিণ তীর থেকে কাঁসাইয়ের উত্তর তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, আবার পশ্চিমে ঝালদা থেকে দক্ষিণে বুধপুর পর্যন্ত ছিল তার সীমানা। |
রাজা রুদ্রশিখরের সময় জৈনরা তামার ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি করেছিলেন। সে কালের পুরুলিয়ায় দুটি বিখ্যাত তামার খনি ছিলতামাজুড়ি ও তামাখুন। এই দুটি খনি থেকে তাঁরা তামার আকরিক সংগ্রহ করে পৌঁছতেন তৈলকম্প বন্দরে। তারপরে নৌকায় করে যেতেন তাম্রলিপ্ত বন্দর, আর সেখান থেকে সমুদ্রবাণিজ্যে। এত বড় তামার ব্যবসা ছিল বলেই হয়ত তাম্রলিপ্ত বন্দরের ওই নাম। এ ছাড়াও সে কালের একটি বিখ্যাত সড়ক পথের পরিচয় আমরা খুঁজে পাই মেদিনীপুর জেলার তমলুক থেকে ক্রমশ উত্তর দিকে রূপনারায়ণ নদের পশ্চিম তীর বরাবর ঘাটাল মহকুমার ক্ষেপুতপুর-দাসপুর-পান্না-ঘাটাল হয়ে শিলাবতী নদী অতিক্রম করে শিলাবতীকে কখনও দক্ষিণে আবার কখনও বামে রেখে বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর ছাতনা ও শুশুনিয়া হয়ে পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর ও তেলকুপির উপর দিয়ে। এই সড়কপথ ধরেও হয়ত জৈন ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ত্রিপুরা বসু। এই ধনী জৈন ব্যবসায়ীরাই এক দিন তৈলকম্পের বুকে নির্মাণ করেছিলেন শিখর রীতির অনেকগুলি সৌন্দর্যমণ্ডিত দেবদেউল। মন্দিরগুলি সবই ছিল পাথরের তৈরি। ১৮৭৮-এ জে ডি বেগলার এখানে ২২টি দেউল দেখতে পেয়েছিলেন। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের সে সময়ের বিবরণীতে তার তথ্য আছে। ১৯০২-এ থিয়োডোর ব্লক, এবং ১৯৬০-এর শেষ দিকে ডেভিড ম্যাককাচ্চন এখানে দেখতে পান দশটি দেউল। ডি ভি সি-র বাঁধ নির্মাণের সময় পুরো অঞ্চলটিই জলের তলায় তলিয়ে যায়। মন্দিরগুলি ধ্বংস হওয়ার বিষয়টি প্রায় শেষ পর্যায় পর্যন্ত কেউ খেয়ালই করেননি।
অন্ধ্রপ্রদেশের নাগার্জুনকোণ্ডায় নাগার্জুনসাগর বাঁধ নির্মাণের সময় যে পুরা-নিদর্শনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের তৎপরতায় তা পুরোপুরি তুলে নিয়ে গিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয় জলাধারের মধ্যে একটি দ্বীপে। বহু ভ্রমণকারী নিয়মিত তা দেখতে যান, তাকে কেন্দ্র করে নাগার্জুনকোণ্ডায় রীতিমতো পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আর তেলকুপিতে শুধু দেবলা মিত্র শেষ অবস্থায় মন্দিরগুলি পরিদর্শন করে একটি অমূল্য বিবরণী তৈরি করতে পেরেছিলেন, পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ প্রকাশিত তাঁর বইটির ছবি ও তথ্য থেকে এই প্রত্নস্থলের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। তখন আর কিছুই করার ছিল না। বাংলার এত গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরীতে কোনও উৎখনন হল না, হলে হয়ত ইতিহাসের কিছু অজানা সূত্র উদ্ঘাটিত হত।
বর্তমানে তেলকুপিতে অবশিষ্ট আছে মাত্র তিনটি দেউল। তার মধ্যে একটি সারা বছর জলমগ্ন থাকে। দুটির অবস্থা অত্যন্ত মর্মান্তিক, দেউলের পাদ অংশ সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষয়ে গিয়েছে, উপরের অংশও নিশ্চিহ্ন। যে কোনও মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। এমনকী পশ্চিমে কিছুটা হেলেও পড়েছে। ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এ দিকে যদি এখনই একটু নজর দেয় তা হলে হয়ত আরও কিছু দিন টিকে থাকবে বন্দরনগরী তৈলকম্পের অন্তিম নিদর্শন। |