সম্পাদক সমীপেষু ...
হেমন্তদা নয়, দ্বিজেনদা
আনন্দবাজার পত্রিকার অতিরিক্ত পাতায় শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরীর ওপর কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে (১০-৯), যাতে সলিলদা-র সংগীত নির্মাণ সম্পর্কে আমার প্রিয় সুরকার শান্তনু মৈত্রের কিছু অভিমত পাঠ করলাম। শান্তনুর একটি মূল্যায়ন সঠিক বলে আমিও মনে করি যে, সলিল চৌধুরীর সংগীত সৃষ্টির ভাবনা ও বোধের মধ্যে একটা সত্যনিষ্ঠ দায়িত্বপূর্ণ দায়বদ্ধতা ছিল। যে তীক্ষ্ম এক-দৃষ্টি নজর, তার বিচিত্রগামিতাতেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। মন্তব্যটি যথেষ্ট সুচিন্তিত গবেষণায় সুষমামণ্ডিত, এতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু উপমাটি ভয়ঙ্কর ভাবে প্রতিবাদসাপেক্ষ। যে ফাস্ট বোলারের লক্ষ্য উইকেট না-হয়ে ব্যাটসম্যানের মাথা হয়, সেই বোলারের আচরণ যথেষ্ট দক্ষ খেলোয়াড়ের মতো নয়। সে খেলোয়াড় খেলার কৌশলের পূজারি কিন্তু উৎকর্ষে অভিপ্রেত ভাবে নিষ্ঠ নয়। সুরস্রষ্টা সলিলদার সংগীত নির্মাণের বোধে তিনি হচ্ছেন মহাভারতের অর্জুন। যিনি অস্ত্র পরীক্ষায় কেবল পাখির চোখ দেখতে পান। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম রক্ষা করেন। অনুশীলন, একাগ্রতা, সাধনার যিনি প্রাণবন্ত প্রতীক। অর্জুনের মতো স্বধর্ম পালন করেন।
এই সলিল চৌধুরীই তাঁর স্থিতধী, স্থিরদৃষ্টি ও বোধ দিয়েই ‘একদিন ফিরে যাব চলে’ ও তাঁর হিন্দি ‘অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’ গান দুটির জন্য শিল্পী হিসেবে বেছে নেন হেমন্তদা নয়, দ্বিজেনদাকে। শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় বাংলা গানের জগতে যাঁর বেশ দীর্ঘ সময়ের বিচরণ। আর এই গানের সঙ্গে কিছু ইতিহাস জড়িয়ে আছে যা আমি জানি। তা প্রকাশ করতে ইচ্ছা করি। কারণ, গান দুটি যেমন জনপ্রিয় ও সলিল চৌধুরীর অন্যতম অনবদ্য সৃষ্টি এর সঙ্গে জড়িত ইতিহাসটিও তেমনই জানার মতো।
প্রথমেই হিন্দি বাণীর গানটি ‘অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল’-এর বিষয়ে বলছি। কারণ, ওই গানের রেকর্ডিংকে ঘিরে যা যা ঘটনা তা শুধু দ্বিজেনদার ইতিহাস নয়, বাংলা সংগীত জগতের কাছেও বিস্ময়কর।
একটি গান নির্মাণের পর শিল্পী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সলিলদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, যে গানে যাকে প্রয়োজন সেই গানের জন্য তাকেই নির্বাচন করা। যেমন ‘আনন্দ’ ছবিতে সব গান গাইছেন ভগবৎ আশীর্বাদপুষ্ট শিল্পী মুকেশ। কিন্তু নায়কের জীবনের গভীরতার প্রেক্ষাপটে গানটি যখন অধিকতর জীবন দর্শনের বোধে বন্দিত করতে হল, তখন তিনি সেটা গাওয়ালেন মান্না দে-কে দিয়ে। মুম্বইয়ের চিত্রজগতে যখন মাতালের মুখে গান থাকলে তা অবশ্যই গাওয়ানো হত রফি সাহেবকে দিয়ে, সেই সময়ে রাজ কপূরের ‘একদিন রাত্রে’ ছবিতে মাতালের গান গাওয়ালেন মান্না দে-কে দিয়ে। আর এমনই সে গান হল যে, ভবিষ্যতে বাংলা ছবিতে বোধহয় ‘বিপিনবাবুর কারণসুধা’ ছাড়া সব মাতালের মুখের গান গাইবার জন্য নির্বাচিত হতেন মান্না দে।
এ হেন সলিল চৌধুরী ‘মায়া’-র মতো বিগ বাজেটের ছবি, যার নায়ক সে দিনের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বয়ং চিরযুবক দেবানন্দ সাহেব, তার প্রেক্ষিতে বেছে নিলেন কলকাতার বাংলা গানের শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। আর চতুর্দিক কাঁপিয়ে যে বোমাটি ফাটালেন, সেটা হচ্ছে সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরকে আহ্বান করলেন কলকাতার সেই শিল্পীর সঙ্গে কোরাস সিঙ্গারদের পাশে এক-সারিতে দাঁড়িয়ে কাউন্টার মেলোডি গাইবার জন্য। আমার জানা নেই এমন কেউ ছিলেন বা আছেন কি না যিনি এই কাজ করার জন্য লতাজিকে বলতে সাহস পেতেন। কিন্তু অর্জুন তার ক্ষত্রিয় ধর্মই পালন করতে বদ্ধপরিকর। এই গানটা দ্বিজেন গাইবে এটা তাঁর স্থির করা হয়ে গেছে কাউন্টার মেলোডির হামিং-টা লতা গাইবে, কারণ, তাতে তাঁর সাজানোটা অভিপ্রেত উৎকর্ষে পৌঁছবে। সলিল চৌধুরী দক্ষ বোলার, উইকেটই তাঁর লক্ষ্য, ব্যাটসম্যানের মাথা নয়। গানটার সাফল্য দ্বিজেনদার জীবনে কেবল ইতিহাস নয়, সংগীতজগতে সত্যের জোর কতটা, তারই দৃষ্টান্তস্বরূপ। কিন্তু পাঠকবর্গ, আরও একটা ইতিহাস আছে যা আপনাদের গোচরে না আনলে আমার রচনাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে না।
রেকর্ডিংয়ের আগের দিন রাত সাড়ে দশটা। দুই প্রাণের বন্ধুর বাণী বিনিময়।
সলিলদা দ্বিজেন, চল একটু টেবিল টেনিস খেলি।
দ্বিজেনদা সে কী রে? কাল আমার রেকর্ডিং। (সলিলদা যেন আকাশ থেকে পড়লেন)
সলিলদা অ্যাঁ, তোর রেকর্ডিং! (বিস্মিত) তোর রেকর্ডিং কী রে? ও তো আমার রেকর্ডিং। চল, খেলি।
দ্বিজেনদা না, তুই বুঝছিস না। গলাটা ঠিক রাখতে হবে তো। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে।
সলিলদাদেখো দ্বিজেন, এ রকম করলে কিন্তু আমি রেকর্ডিং বন্ধ করে দেব। (বন্ধুত্ব বিগড়ে গেলেই সলিলদা সম্বোধন বদলে ফেলত। তুইটা তুমি হয়ে যেত। আমারও এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে।)
সলিলদা দ্বিজেন, তোমার রেকর্ড করতে হবে না। তুমি কলকাতায় চলে যাও।
দীর্ঘ বন্ধুত্বের দৌলতে উভয় উভয়কে ভাল ভাবেই চেনেন। দ্বিজেনদা বুঝলেন আজ সলিলকে টেবিল টেনিস খেলা থেকে বিরত করা যাবে না। মহালয়ার ‘জয় দুর্গা জয় দশপ্রহরণধারিণী’ গাইতে গাইতে দ্বিজেনদা খেলতে রাজি হলেন। খেলা চলল রাত তিনটে পর্যন্ত। কিন্তু সে দিন খেয়ালি বন্ধুর মর্জিকে আশ্রয় দিয়ে যা পাওয়া গেল তা গানের জগতে পরম ঐশ্বর্যময় সম্পদ। আর দ্বিজেনদার জীবনের দীর্ঘ ইতিহাসের পাতায় এক নক্ষত্র সংযোজন। আমার মন বেদনার্ত হলেই আমি বসে শুনি আর কাঁদি
অ্যায় দিল কাঁহা তেরি মঞ্জিল
না কোই দীপক হ্যায়
না কোই তারা হ্যায়
গুম হ্যায় জমিন দূর আঁসমা।


এ হেন গানের ক্রেডিট কার্ড যদি অন্যের মাথার শিরোপা করে দেওয়া হয়, তবে আসল শিল্পীর বেদনা ও প্রকাশের ভ্রান্তি দুটোই বড় বেদনাদায়ক।
শান্তনু ভাই, তুমি আমার একজন প্রিয় সুরকার। প্লিজ নোট, যখন মুম্বই সংগীতজগতে তাবড় তাবড় শিল্পী জনপ্রিয়তার তুঙ্গে বসে আছে, সেই সময় ওই গানের জন্য উনি দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে নির্বাচন করেছিলেন! সেই সময় সুরস্রষ্টা কে? যাঁর মৃত্যুর পর নৌশাদজি বলেছিলেন, ‘ওয়ান অব দ্য সেভেন নোটস হ্যাজ বিন লস্ট।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.