নরেন্দ্র মোদী সদ্ভাবনা জাগ্রত করিবার লক্ষ্যে অনশনে বসিয়াছেন। এবং আপন সৎ-ভাবনার প্রমাণ হিসাবে, অনশনে বসিবার পূর্বলগ্নে প্রচারিত খোলা চিঠিতে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ‘গত দশ বছরে সত্যই যে ভুলগুলি’ করিয়াছেন তাহার জন্য কার্যত ভারতবাসীর নিকট ক্ষমা চাহিয়াছেন। অনুমান করা খুব কঠিন নহে যে, ইহা প্রধানত গুজরাতে ২০০২ সালে সংখ্যালঘু নিধনের ভয়াবহ ইতিহাসের জন্য তাঁহার ‘ভুল স্বীকার’। খোলা চিঠিতে সরাসরি ‘সাম্প্রদায়িক হিংসা’র উল্লেখ এবং ‘সাম্প্রদায়িকতা কখনও সমাজের পক্ষে হিতকর হয় নাই’ বলিয়া স্বীকারোক্তি বুঝাইয়া দেয়, নরেন্দ্র মোদী ইতিহাসের দায় হইতে নিষ্কৃতি চাহিতেছেন। অনুতাপ এবং ক্ষমাপ্রার্থনা ভাল, ক্ষমতার অধীশ্বররা তাহা করিলে দ্বিগুণ ভাল। তবে কিনা, ক্ষমাপ্রার্থীর ভাবনাটি সৎ হওয়া অতীব জরুরি। মোদী যদি ২০০২ সালের সংহারপর্বের পরেই, অন্তত কিছু কালের মধ্যেই ক্ষমাপ্রার্থী হইতেন, তাঁহার ভাবনার সততা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হইত। তিনি ক্ষমাপ্রার্থী এবং সদ্ভাবনাকামী হইলেন কখন? যখন বাতাসে নির্বাচনের ঘ্রাণ ভাসিতেছে, সেই নির্বাচনে তাঁহার আপন দলের ‘প্রমুখ’ হইয়া উঠিবার, সুতরাং প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হইবার সম্ভাবনা জাগিয়া উঠিয়াছে এবং গুজরাত-২০০২ সেই সম্ভাবনার পথে অঙ্কুশ হিসাবে গণ্য হইতেছে। সুতরাং এমন ধারণা নিতান্ত অযৌক্তিক হইবে না যে, গুজরাতের বাহিরে বৃহত্তর ভারতের নিকট গ্রহণযোগ্য হইয়া উঠিবার নির্বাচনী তাগিদেই মোদী ক্ষমাপ্রার্থী। খোলা চিঠিতে ‘নিষ্ঠার সহিত জনসাধারণের কাজ করিবার জন্য’ তাঁহাদের ‘আশীর্বাদ’ ভিক্ষাও নিছক ভোটভিক্ষার অনুরূপ শুনাইলে বিস্ময়ের কিছু নাই।
তথাপি, নেই-অনুতাপ অপেক্ষা কানা-অনুতাপ ভাল। সুসজ্জিত মঞ্চে তিন দিনের অনশন কর্মসূচিও রাজনীতির হাতিয়ার হিসাবে দাঙ্গা কিংবা ভাঙচুর অথবা বন্ধ-অবরোধ অপেক্ষা শ্রেয়। এবং, কে বলিতে পারে, নিতান্ত কৌশল হিসাবে অনশন বা ক্ষমাপ্রার্থনা অনুশীলন করিতে করিতেই এমনকী নরেন্দ্র মোদীরও চিত্তশুদ্ধি ঘটিবে না? ‘মরা’ ‘মরা’ই তো ‘রাম রাম’ হইয়াছিল, শব্দগুণেই। সে কালে অবশ্য সিদ্ধিলাভের জন্য লক্ষ লক্ষ বৎসর তপস্যার প্রয়োজন হইত, কিন্তু সে রামও নাই, সে রত্নাকরও নাই, পাঁচসালা নির্বাচনের যুগে তিন দিন অনেক সময় বটে! নিন্দুকে অবশ্য বলিতে পারেন, অনশন বা অনুরূপ আত্ম-আঘাতী সাধনার জন্য বড় কিছু বাজি রাখিতে হয়, যথা দধীচির অস্থি কিংবা বিশ্বামিত্রের প্রাণ। রামচন্দ্র যুদ্ধজয়ের জন্য আপন নীলোৎপল-নয়ন শেষ অবধি বিসর্জন দিতেন কি না, তাহা বাল্মীকিরও অজানা, কিন্তু অন্তত দেবীর অন্তঃকরণে তেমন একটি বিশ্বাস তিনি জাগ্রত করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়াই দেবী চরম মুহূর্তে আবির্ভূতা হন। নরেন্দ্র মোদী তেমন কোনও আত্মবিসর্জন দিতে প্রস্তুত নহেন, তবে তাঁহার যুদ্ধজয় হইবে কেন? এই প্রশ্নের সরল উত্তর নাই। নিন্দুকে বলিবেন: ঘোর কলি!
তবে কলিকালের যত নিন্দাই হউক, মোদী-কাহিনির আলোয় একটি অতি আশ্বাসদায়ক সত্য নূতন করিয়া প্রতিভাত হইল। কলিযুগে নির্বাচনী গণতন্ত্র নামক যে ব্যবস্থাটি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার মহিমা সত্য ত্রেতা দ্বাপরের কোনও দেবতা বা মুনি-ঋষির অপেক্ষা কম নহে। ভোটের দায় বড় দায়, তাহার তাড়নায় স্তালিনবাদী হইতে হিন্দুত্ববাদী, সব ধরনের কট্টরপন্থীদেরই শেষ পর্যন্ত এক ঘাটে জল খাইতে হয় সহিষ্ণুতার ঘাট। অন্ত হইতে কে কত শতাংশ সহিষ্ণু হইতে পারিলেন, তাহা মনোবিদরা বুঝিবেন, কিন্তু ভারতের মতো দেশে নির্বাচনে বৃহত্তর এবং দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য অর্জন করিতে চাহিলে কার্যক্ষেত্রে বহুজনকে সঙ্গে লইয়া চলিতেই হইবে, কেবল ‘আমাদের’ স্বার্থ দেখিয়া ‘উহাদের’ দূরে রাখিলে বা সংহার করিলে দিল্লি দূর অস্ত্। নরেন্দ্র মোদী তাঁহার অনশন, অনুশোচনা, মার্জনাভিক্ষাদি দশকর্মপ্রকরণ দিয়া দিল্লিকে কাছে আনিতে পারিবেন কি না, তাহা ভবিষ্যৎই বলিতে পারে। ভারতীয় গণতন্ত্র বলিবে: আজ আমি জয়ী। |