বিদ্যুৎ, ফোন নেই, বন্ধ জাতীয় সড়ক
ভয়ে পথেই রাত জাগল পাহাড়
নিবার রাতভর বৃষ্টি হয়েছে। হয়েছে ছোটবড় ধস। রবিবার সকাল থেকেও ছবিটা বদলায়নি। গাছ পড়ে পাহাড়ের রাস্তাঘাট মাঝেমধ্যেই বন্ধ হচ্ছিল। সঙ্গে ছিল ধস -ফাটল।
কিন্তু রবিবার সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটের পরে যা ঘটল, তা দুঃস্বপ্ন হয়ে সিকিম -দার্জিলিংয়ের মানুষকে বহু বছর তাড়া করবে। প্রথমে কয়েক সেকেন্ডের তীব্র কাঁপুনি। পরের আধ মিনিট ধরে পরের পর কম্পন। তাতেই পুরোপুরি ধসে পড়ল পাহাড়ের জনজীবন। পাহাড়ে হতাহতের সঠিক তথ্য গভীর রাত পর্যন্ত প্রশাসনের কাছে নেই। বস্তুত, একটা ভূমিকম্প পাহাড়ের জনজীবনের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে। বহুতল ভেঙেছে। অসংখ্য বাড়িতে ফাটল। রাস্তায় গর্ত। টেলি -যোগাযোগ বিপর্যস্ত। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বিদ্যুৎ নেই এলাকায়। চিৎকার চারপাশে। আটকে পড়েছেন অনেক পর্যটক। সব মিলিয়ে ভয় ভোগান্তির মর্মান্তিক ছবি পাহাড় জুড়ে।
বৃষ্টি বা ছোটবড় ধস থেকে শুরু করে গাছ পড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন -- বর্ষার মরসুমে এমন দুর্যোগের দিন পাহাড়ে নতুন কিছু নয়। মৃদুমন্দ কম্পনও যে আগে কখনও হয়নি, এমন নয়। কিন্তু দিন সন্ধ্যায় যা হল, তার অভিঘাত যেমন কয়েক গুণ বেশি, তেমনই তার আতঙ্কও কাটিয়ে উঠতে পারছেন না পাহাড়বাসী। দার্জিলিং পাহাড় লাগোয়া সিকিমের কেন্দ্রে এমন মাপের ভূমিকম্প গত কয়েক দশকে হয়েছে কি না, মনে করতে পারছেন না কেউ। ভয়ে, আতঙ্কে রাতটা কার্যত রাস্তায় কাটিয়েছেন সিকিম, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াঙের মানুষ। সিকিম তো বটেই। যে পাহাড় খাদ্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জন্য অনেকটাই সমতলের উপরে নির্ভরশীল, সেখানে এই ভূমিকম্পের পরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এর পরে কী হবে, তা ভেবে আতঙ্ক আরও বাড়ছে সাধারণ মানুষের।
দিনের প্রায় ৩০ সেকেন্ডের প্রবল ভূকম্পের জেরে ধস নেমে ফাটলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে শিলিগুড়ি থেকে সিকিমগামী ৩১ - জাতীয় সড়ক। দিল্লি থেকে রাতেই বিশেষ বিমানে দুর্যোগ মোকাবিলার বিশেষজ্ঞদল রাতে বাগডোগরা এসে পৌঁছচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পাহাড়ের অবস্থা খতিয়ে দেখতে আজ, সোমবার সকালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি আসছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব।
শিলিগুড়িতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছেন আতঙ্কিত বাসিন্দারা। রবিবার সন্ধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
ভূকম্পের উৎসকেন্দ্র সিকিমের গ্যাংটক থেকে ৬৪ কিলোমিটার দূরে নর্থ সিকিমের মঙ্গনে। চিরাচরিত ভাবেই পাহাড়ের মানুষের বহু আত্মীয়স্বজন কর্মসূত্রে সিকিমে থাকেন। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, গ্যাংটক, পেলিং -সহ সিকিমের বহু এলাকায় পর্যটকেরা আতঙ্কে রাত কাটাচ্ছেন। গ্যাংটকের পালজোর স্টেডিয়াম খুলে পর্যটক সাধারণ বাসিন্দাদের রাখা হয়েছে। এক হাজারেরও বেশি পর্যটক গ্যাংটক, পেলিং এলাকায় আছেন। বহুতল, বাড়ি, শপিং মল ভেঙে পড়ার খবর মিলেছে। ইস্টার্ন হিমালয়ান ট্র্যাভেল অ্যান্ড ট্যুর অপারেটরর্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সম্রাট সান্যাল বলেন, “সিকিমের অবস্থা খুবই খারাপ। জাতীয় সড়ক বন্ধ। আমরা সিকিম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। পযর্টকদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সিকিম সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।” লাভা, লোলেগাঁওয়ের মতো এলাকাতেও বহু পর্যটক সেখানে আটকে পড়েছেন।
ভূকম্পের পরেই উত্তরবঙ্গের অন্যান্য এলাকার মতো বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গিয়ে অন্ধকারে ডুবে যায় গোটা পাহাড়ে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় পাড়ায় পাড়ায়। দার্জিলিং চিড়িয়াখানার হরিণ থেকে রেড পান্ডা নির্দিষ্ট খাঁচার ভিতর থেকে বার হয়ে ঘেরা এলাকায় দৌড়োদৌড়ি শুরু করে দেয়। চিড়িয়াখানার
প্রাণীদের আর্তনাদে এলাকায় আরও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়। ল্যান্ডলাইন মোবাইল নেটওয়ার্ক মুহূর্তের মধ্যে বসে যায়। বাড়ি ছেড়ে দার্জিলিঙের ম্যাল চৌরাস্তা, লাডেনলা রোড, এনসি গোয়েঙ্কা রোড, গাঁধী রোডে ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছেন কাতারে কাতারে মানুষ। সিকিমেও ছিল একই ছবি। বারবার ফোন করেও বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আত্মীয় -পরিজনদের খোঁজখবর না পেয়েও অনেকে কান্নাকাটি জুড়ে দেন।
দার্জিলিং হাসপাতালে বড় মাপের ফাটল দেখা দেওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। কম্পন অনুভূত হওয়ার পরেই রোগীদের বাইরে বার করে দেন নার্স, চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। দার্জিলিং মিউজিয়ামের কিউরেটর চন্দ্রনাথ দাসের বিবরণ, “রবিবার সন্ধ্যায় বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ কম্পিউটার, অ্যাকোয়ারিয়াম ভেঙে পড়ল। বুঝলাম ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু এত তীব্র কম্পন আমার জীবনে দেখিনি। মেয়ে ভয়ে কান্নাকাটি করছে। টেলিফোন, বিদ্যুৎ না থাকায় আরও আতঙ্ক বেড়েছে। বাড়ির বাইরেই রাত কাটাব ঠিক করেছি। এলাকার লোকজনও
রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন। সবাই একসঙ্গে থাকলে তা - কিছুটা মনে জোর আসে।”
রাতের মধ্যে আবার কম্পন অনুভূত হতে পারে, এই খবরে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার তরফে তিন জন বিধায়ক এবং দলীয় নেতারা পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর শুরু করেন। কিন্তু টেলিফোন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তাঁরাও সমস্যায় পড়েন। টুনসুং চা বাগানে দলীয় কাজে গিয়ে ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে আটকে পড়েছেন মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি। রাতে তিনি বলেন, “ফাটল, ধসে বিপর্যস্ত গোটা পাহাড়। বিজনবাড়ি রাস্তা বন্ধ হয়ে চা বাগানে আটকে আছি। খোঁজখবর নিচ্ছি।”
কালিম্পঙের বহু রাস্তায় ধস নামা ছাড়াও ফাটল ধরেছে। পাকা বাড়ি হোটেল -রিসর্ট এলাকায় দেওয়াল ভেঙে পড়েছে। চিড় ধরেছে অজস্র পাকা বাড়িতে। একই অবস্থা কার্শিয়াঙের। ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা বলেই পাহাড়ে কাঠের বাড়ি করার রীতি রয়েছে। সেই বাড়িগুলির বড় মাপের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও আতঙ্কে ছোটাছুটির সময় জখম হয়েছেন অনেকে। লোডশেডিং -এর জন্য প্রশাসনের পক্ষে উদ্ধারকাজ সুষ্ঠুভাবে চালানোও সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বৃষ্টি তো আছেই। বহু জায়গায় জলের ট্যাঙ্ক ভেঙে, উল্টে, পাইপ ফেটে যাওয়ায় পানীয় জলের সমস্যাও দেখা দিয়েছে।
কার্শিয়াঙের বাসিন্দা ভিমবাহাদুর থাপা, সূরজ শর্মা, সোনাদা, ঘুমের অলকমণি গুরুঙ্গ, প্রতিমা ছেত্রী, কালিম্পঙের নিরজ থাপা, দেবস্মিতা ঘোষেরা বলেন, “মৃত্যুর মুখ থেকে কী ভাবে বেঁচে আসতে হয়, তা আমরা আজ টের পেলাম। চারদিকে শুনতে পারছি, আবার হতে পারে। কী যে হবে বুঝতে পারছি না।”
এই আতঙ্ক সঙ্গী করেই রবিবারের রাত জাগবে পাহাড়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.