সোনা, রুপো, শেয়ার না সম্পত্তিএই বাজারে ঠিক কোথায় লগ্নি করা উচিত তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধাগ্রস্ত। শেয়ার এখন ঝিমিয়ে। বাজার গরম সোনা ও রুপোর। অনেকটা ওঠার পর এখন এক রকম স্থির হয়ে আছে সম্পত্তির দাম। এই পরিস্থিতিতে ব্যাঙ্ক-ডাকঘরের বাইরে কোথায় সঞ্চয় করা ঠিক হবে, সেটাই এখন মানুষের প্রশ্ন। তা নিয়ে আলাদা করে আলোচনা করা যাক।
সোনা সব সময়েই সবার প্রিয়। লগ্নির জায়গা হিসেবে কিন্তু সোনার জনপ্রিয়তা বেড়েছে সম্প্রতি। এখন তা এক রকম তুঙ্গে। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক খাঁটি সোনার মুদ্রা বিক্রি করতে নামায় এবং ঋণপত্রের মাধ্যমে সোনায় লগ্নির সুযোগ আসায় এই জনপ্রিয়তা বাড়ছে অতি দ্রুত। পাশাপাশি বাড়ছে দামও। গত এক বছরে যাঁরা গোল্ড ই টি এফ-এ লগ্নি করেছেন তাঁদের লগ্নি মাত্র ১২ মাসে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।
ঝুঁকি এবং অনিশ্চয়তা মোকাবিলায় সোনায় লগ্নি অনেকটা বিমা করার মতো। সোনার গ্রহণযোগ্যতা সারা পৃথিবীতে। অর্থনীতি যত ঝুঁকে পড়বে, সোনার দাম তত বাড়বে। ছোট মেয়াদের কথা বাদ দিলে সোনাকে আমরা কমই নামতে দেখেছি। এতটা ওঠার পরও সোনা আরও বাড়তে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, পশ্চিম দুনিয়ার অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলার দুর্বল হয়ে পড়া এবং সোনার উৎপাদন বৃদ্ধি না-পাওয়া। এই সব কারণে লগ্নিযোগ্য তহবিলের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সোনায় লগ্নি করা থাকলে দুর্দিনে ভরসা পাওয়া যায়। সোনায় লগ্নি করা যায় বিভিন্ন ভাবে।
যেমন:
(১) স্বর্ণকারের কাছ থেকে গয়না কিনে,
(২) ব্যাঙ্ক থেকে পাকা সোনার মুদ্রা কিনে,
(৩) গোল্ড ই টি এফ ফান্ডে লগ্নি করে,
(৪) গোল্ড ফান্ডে লগ্নি করে এবং
(৫) মিশ্র (হাইব্রিড) মিউচুয়াল প্রকল্পে লগ্নি করে, যারা তহবিলের একাংশ গোল্ড ই টি এফ-এ লগ্নি করে। ডাকঘর অথবা ব্যাঙ্ক আমানতের মতো সোনায় লগ্নি করলে নিয়মিত আয়ের অবশ্য কোনও সম্ভাবনা থাকে না। ভাল ফল পেতে হলে সোনায় লগ্নির মেয়াদ একটু দীর্ঘ হওয়া বাঞ্ছনীয়।
লগ্নির বাজারে রূপ খুলেছে রুপোরও। গত দু’বছরে তা টেক্কা দিয়েছে সোনাকেও। শিল্পে রুপোর ব্যবহার বাড়ছে অতি দ্রুত। বিশেষ করে সৌর শক্তি উৎপাদন ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে। রুপোর দাম বাড়তে থাকায় রুপো কিনতে শুরু করেছেন বহু লগ্নিকারীও। ফলে কয়েক গুণ বেড়েছে রুপোর চাহিদা। তা এই ভাবে বাড়তে থাকলে আগামী তিন-চার বছরের মধ্যেই রুপোর ঘাটতি দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা। রুপোর দামে মাঝে-মধ্যে সংশোধন দেখা দিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা আরও অনেকটা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। কলকাতায় ১ কেজি রুপোর বাটের দাম এখন ৬৪,০০০ টাকার আশপাশে। রুপো বিশেষজ্ঞ ডেভিড মরগ্যানের ধারণা, দীর্ঘ মেয়াদে কেজি প্রতি রুপোর দাম পৌঁছে যেতে পারে ২ লক্ষ টাকায়। অর্থাৎ সঞ্চয়যোগ্য তহবিলের একাংশ লগ্নি করা যেতে পারে রুপোতেও।
গত কয়েক বছরে মোটা লাভের সন্ধান দিয়েছে সম্পত্তিও। অস্বাভাবিক হারে দাম বেড়েছে বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটের। গৃহঋণে সুদ বেড়ে ওঠায় এখন চাহিদা কিছুটা নীচের দিকে। কলকাতায় চাহিদা কিছুটা থমকে দাঁড়ালেও বেহালা, নরেন্দ্রপুর, ব্যারাকপুর, বারাসত, উত্তরপাড়ার মতো শহরতলিতে চাহিদা বাড়ছে অতি দ্রুত। অনেক বড় মাপের নির্মাণকারী সংস্থা এরই মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে এই সব জায়গায়। যে সব অঞ্চলে মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের কথা আছে, সেখানে চাহিদা বাড়ছে হু হু করে। সংশ্লিষ্ট জায়গার ভবিষ্যৎ বুঝে ভাল নির্মাণ সংস্থার প্রকল্পে লগ্নি করলে সবুরে মেওয়া ফলার সম্ভাবনা থাকবে। তাকানো যেতে পারে শিলিগুড়ি, বর্ধমান, দুর্গাপুর আসানসোল, ইত্যাদির মতো মাঝারি মানের শহরগুলির দিকেও। যাঁরা ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তাঁরা দাম আরও বাড়ার আগে একটি বাসস্থান কিনে ভাড়ার টাকায় ই এম আই প্রদান করলে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পত্তির মালিক হবেন, যার বাজার দর তখন কয়েক গুণ বেড়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। ফ্ল্যাট কিনে তা সাবধানতার সঙ্গে ভাড়া দিয়ে ভাড়ার টাকায় ঋণশোধ করে সম্পত্তির মালিক হওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। লগ্নি হিসেবে প্লটও কিনে রাখা যেতে পারে সুরক্ষিত জায়গায়।
সব শেষে আসা যাক শেয়ারের কথায়। অন্যান্য সম্পদে ভাল লাভের সম্ভাবনা থাকলেও শেয়ারের কাছে সবই তুচ্ছ। তুচ্ছ ঝুঁকির ব্যাপারেও। বড় মাপের ঝুঁকি থাকলেও শেয়ারের মতো লাভ কোনও সম্পদেই হওয়া সম্ভব নয়। এই কারণেই শেয়ার বাজারে এত ভিড়। ২০০৮-এর মহাপতনের পর যাঁরা শেয়ারে লগ্নি করেছিলেন তাঁদের অনেকে এক বছরের মধ্যেই ১০০ শতাংশ লাভের সন্ধান পেয়েছেন।
সময় এবং সুযোগের সদ্ব্যবহারই শেয়ার বাজারে সাফল্যের মূল মন্ত্র। দীর্ঘ মেয়াদে অল্প অল্প করে শেয়ারে লগ্নি এক সময়ে বড় সম্পদে পরিণত হতে পারে। যত কম বয়স থেকে লগ্নি শুরু করা যায়, ততই ভাল। কম বয়সে বেশি ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব। বয়স বাড়লে তা কমতে থাকে। বয়সের নিরিখে লগ্নিযোগ্য তহবিলের ২৫ থেকে ৫০% পর্যন্ত শেয়ারে লগ্নি করা যেতে পারে।
অর্থাৎ সোনা, রুপো, শেয়ার ও সম্পত্তি এই চার রকমের সম্পদ শ্রেণিতেই লগ্নি করে কম-বেশি লাভের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। কে কোন সম্পদে কতটা লগ্নি করবেন, তা নির্ভর করবে নিজের নিজের অবস্থান এবং ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার উপর। |