|
|
|
|
|
|
|
রেখায় রেখায় |
পম্পা বিশ্বাস |
হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন? হ্যাঁ, দিদি ফিরেছে। অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে আছে স্তব্ধ হয়ে। যা দিদির স্বভাববিরুদ্ধ। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি, এ বার দিদি ফেটে পড়বে রাগে। চিৎকার, নয়তো বিষ ঢালা কথা। বুকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবে একেবারে। কিন্তু সেই দিদি কিছুই বলছে না! কী ব্যাপার হল!
অন্ধকারের মধ্যেই আস্তে আস্তে খাটে বসে পড়ল দিদি। আমি তো ভ্যাবাচ্যাকা। তাড়াতাড়ি টেবিলের ড্রয়ার হাতড়াই দেশলাই কোথায়? পেয়েছি। মোম কোথায়? জানলার তাকটায়। পেয়েছি। ব্যস, এ বার জ্বেলে ফেলব। তখনই দিদির ফ্যাসফেসে গলা আলো জ্বালিস না।
বলে কী! আরও ঘাবড়ে গেলাম। সেঁটে গেলাম চেয়ারের সঙ্গে। পা’গুলো হয়ে গেল কংক্রিটের।
কী হল দিদির?
সাহস হল না কিছু জিজ্ঞাসা করার।
অন্ধকারের মধ্যে ফোঁপানি শুনতে পেলাম। প্রথমে আস্তে। তার পর খুব জোরে জোরে। তার পর প্রলাপ।
প্রলাপ থেকে বোঝা গেল, দিদির চাকরি চলে যাচ্ছে। মোট চুয়ান্ন জনকে আজ ভি আর এস ধরানো হয়েছে। দেশের বৃহত্তম স্বার্থে ইউনিয়ন এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে। সামান্য কিছু টাকা আর যা কিছু বাকি পাওনাগণ্ডা, অফিস সাত দিনের মধ্যে মিটিয়ে দেবে।
লোডশেডিং শেষ হয়েছে। চারিদিকে আলো এসে গেল। শুধু আমাদের ঘর রইল অন্ধকার। কারণ, আমি তো সুইচ অন করে রাখিনি। আজ আর আলো জ্বালানো হল না। দুই বোন বসে রইলাম, দিদি খাটে আমি চেয়ারে। দিদির স্নায়বিক উত্তেজনা এক সময় থেমে এল। খুব করুণ গলায় বলল কাল এক বার রুনা বউদির কাছে যাস। যাবি তো? আর এক বার চেষ্টা করে দেখ না। রোজগার তো করতে হবে। নইলে খাব কী?
বছরখানেক আগে দিদি আমায় পাঠিয়েছিল রুনা বউদির কাছে, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। ওঁর রমরমে ব্যবসা। শাড়িতে বাটিক, এমব্রয়ডারি, ফেব্রিক, কাঁথাস্টিচ, গুজরাতি স্টিচ... আরও কত কী। অনেক মেয়ে কাজ করে। আমারই মতো। আধপেটা খাওয়া মেয়ের দল।
মিনতি ভরা চিঠি লিখে সেবার দিদি আমায় পাঠিয়েছিল। ‘পাড়ার মেয়ে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়, দয়া করে কাজ শিখিয়ে কিছু আয়ের ব্যবস্থা করে দিন’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ততদিনে আমি ভগবানদত্ত রেখাগুলো পেয়ে গিয়েছি। বলা যায়, রেখার প্রবাহের মধ্যে সাঁতার কাটছি। এর ফল দাঁড়িয়েছিল খুব খারাপ। বউদির পরীক্ষায় আমি ফেল। তবুও দয়ার শরীর তাঁর। বহাল হয়েছিলাম ফেব্রিকের দলে।
ছবির পরিকল্পনা তাঁর নিজের। বাজার চলতি। একঘেয়ে। গতানুগতিক। গ্যাদগ্যাদে। প্রথম কয়েকটা শাড়িতেই ডাব্বা। ও সব নরম ন্যাতপেতে তুলিটুলিগুলো আমার একদম সহ্য হয় না। শক্ত কিছু হলে যেন ভাল। তখন তো সদ্য সদ্য আমি ব্লেড-আলপিনে সওয়ার হয়েছি। নিজের কেরামতি দেখাতে গিয়েই বাধল মুশকিল। রেখায় জাহির করতে গিয়েছিলাম নিজের বৈশিষ্ট্য। ব্যস, বাতিল। চাকরি নট। সে-বার বউদি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, আঁকা-জোকা আমার জন্য নয়। তাই পত্রপাঠ বিদায়।
আমি কিন্তু তখন বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছিলাম। ওই সব আলুনি ছবিগুলো... ওঃ গা গুলিয়ে ওঠে এখনও।
কিন্তু এখন ভাবছি, ইদানীং মাথার ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে বলে হয়তো এটাই উপযুক্ত সময়। এ বার হয়তো পাশ করব বউদির পরীক্ষায়। আর পাশ করলেই চাকরি। চাকরি হলেই টাকা। গেলে হয় আর এক বার। অসুবিধা তো কিছু নেই। নিজের আঁককাটার কাজ তো প্রায় বন্ধই এক রকম। মাথা থেকে রেখা বেরোচ্ছে না। ব্লেডগুলো পড়ে আছে ফালতু। আলপিনগুলো কাজহীন। টেবিলটা অজস্র আঁকিবুকি নিয়ে নিথর। সঠিক সময় আগত।
কেটে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দিদির চোখের জলে ধোয়া চিঠি নিয়ে হাতে-পায়ে ধরে ফের বহাল হয়েছি শাড়ি-আঁকার কারখানায়। ফেব্রিক রং দিয়ে শাড়ি ভরাচ্ছি। সেই সব গোদা গোদা ছবি। প্রচণ্ড কাটতি শাড়িগুলোর। বউদির পরিকল্পনা। আমরা আদেশ তালিমকারী মাত্র। দিদি মনে হচ্ছে যেন খুশিই হয়েছে। যা হোক দুটো পয়সা তো আসছে।
অবশ্য বেকার হয়ে দিদি অনেকই পাল্টে গেছে। লিপস্টিক নেই, পাউডার নেই। কাজল নেই। কলপ নেই। আঁটোসাঁটো শাড়ি পরা নেই। হিল জুতো নেই। শিকড় আলগা হয়ে গিয়েছে জীবনের। এলোমেলো হতশ্রী অবস্থা। চিৎকার করে না দিদি আজকাল। গুম হয়ে থাকে। চোখের কোণে পিচুটি, মাথায় উকুন, দিনের পর দিন।
মাসে মাসে পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলতে যাই। সামান্য টাকা। তবে আমাদের কাছে প্রচণ্ড দামি। রান্না করি। আর যত কিছু আছে, সব। পরপর পরপর। তার পর কারখানা। মাথাটা আজকাল ফাঁকা বলে সব কাজই করে যাই আনমনে। কষ্ট হয় না। কারখানায় নিচু দরের ফেলু কর্মী আমি, তাই আমার দৈনিক মজুরি নেই, যে মাসে বউদি যা দেন তাই নিতে হয়। টাকাগুলো দারুণ আগ্রহে নিয়ে নিই। রেখে দিই যত্ন করে। কাঠের তাকের মধ্যে। প্রত্যেকটি পাই-পয়সার হিসাব রাখি।
সে দিন ফিরে এসে দেখি, বাড়িতে বেশ ভিড়। কিছুক্ষণ আগে দিদি নাকি রাস্তায় চলন্ত বাসের সামনে লাফিয়ে পড়েছিল। দিদিকে নিয়ে যেতে হল পাড়ার ক্লাবে। সেখানে বিনা পয়সায় কাউন্সেলিং হয়। আত্মহত্যার ঝোঁক হয়েছে দিদির। ঘরে ধারাল জিনিস, দড়ি এই সব রাখা যাবে না।
ঘরে এসে ব্লেডগুলো সব ফেলে দিলাম, এমনকী আলপিনগুলোও। দড়িদাড়াও বাদ দিলাম না কিছু।
ক’দিন বাদে এক গতে বাঁধা কারখানা সকালে হঠাৎ ব্যতিক্রম। রুনা বউদির অফিস কামরায় আমায় তলব। বউদি সুন্দরী। দেখলে চোখের ভারী তৃপ্তি। কিন্তু সোজা চোখে তাকাই না। শত হলেও মনিব বটে। কেমন যেন বুক কাঁপে।
ঢুকলাম কাঁপা কাঁপা হৃৎপিণ্ড নিয়ে। বউদি বসতে বললেন না, টেবিলের মোটা পুরু কাচে পেপার ওয়েট ঠুকে আওয়াজ তুলছিলেন, টুক টুক। বললেন, তোমার কাজ তো একদমই ভাল হচ্ছে না। কী করি বলো তো তোমায় নিয়ে? তোমার দিদি এত করে অনুরোধ করলেন যে...। আচ্ছা, দিদি কেমন আছেন এখন? মাথা হেলালাম, ভাল।
রুনা বউদি নিজের গালে পেনের পিছন দিয়ে আলতো ভাবে ঘা মারছিলেন। আর ভাবছিলেন। বললেন, আসলে আমি আগেই বুঝেছিলাম, তুমি পারবে না। আর তোমাদেরও এখন যা দুঃসময় চলছে! কাজ তোমায় ছাড়াব না। বরং আরও সোজা সোজা ছবি দেব। সঙ্গে দেব আর একটা বাড়তি দায়িত্ব। ফলে টাকা তোমার কমবে না বরং বাড়বে সামান্য। আমার সংসারের একটু হাল ধরতে হবে ভাই। |
|
শুনছি, আর আমার সমস্ত শরীর কংক্রিটে জমে যাচ্ছে।
বউদি হাসছেন। ওঁর কথাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে আসছে।
অন্য ভাবে নিয়ো না ব্যাপারটা। আমরা তো সব একই পরিবারে আছি, তাই না? নিজেরই সংসার ভেবে নিয়ে কাজগুলো করবে।
শুনছিলাম, কারখানার অনেক মেয়েই বউদির বাড়িতে কাজ করেছে। এ বার আমার পালা। যারা বউদির বাড়ির কাজে ফেল করেছে, কারখানার দরজাও বন্ধ হয়ে গেছে তাদের মুখের উপর। চিরতরে।
আরও হাসছেন বউদি।
তা হলে শুরু করে দাও কাল থেকে। আসবে, সকাল আটটায়। তার আগেও না, পরেও না। কাজ সেরে সোজা কারখানায় চলে যাবে। ওখানে বলা থাকবে। সকালে একটা টিফিন পাবে তুমি।
বাড়ি ফিরে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সারা শরীর জমে যাচ্ছিল অবসন্নতায়। ওষুধের ঘুম দিদির। গোটা রাত ধরে নাক ডাকা চলল একটানা। রাত শেষ এক সময়। ভোরের আলোয় চোখ গেল ছবি টেবিলের দিকে। ওগুলোর স্রষ্টা কি আমিই? আমিই কি এঁকেছিলাম ওদের? বিশ্বাস হচ্ছে না একেবারেই।
রোজ আগে রুনা বউদির সংসার। সেখানে বিশাল শ্বেত পাথরের মেঝে। গ্রিলের ছায়ার চিত্রবিচিত্র। সাদার উপর কালো আঁকিবুকি। বিশাল প্রাপ্তি... আহা্! মেঝে মুছতে মুছতে আমি রোজই মুগ্ধ হয়ে যাই। তখন আর কোনও কষ্টই থাকে না। পৃথিবীর সমস্ত রেখা আমার।
আজকে হঠাৎ বউদি আমাকে ডাকছেন নিজের শোবার ঘরে। পিঠে কী একটা ভেষজ ক্রিম লাগিয়ে দিতে হবে। ঢুকে দেখি দরজার দিকে পিঠ ফিরিয়ে আলগা হয়ে আছেন তিনি। এবং আধ শোয়া। খুলে খুলে আসা কাপড়ের প্যাঁচের মধ্যে অদ্ভুত এক শরীর। দৃশ্যটা চাবুকের মতো সপাটে আমার শরীরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। দম আটকে আসছে আমার উঃ। আর, বুকের ভেতর দুমদুম কিল পড়ছে। এমন সময় মনের মধ্যে একটা যেন শব্দ হল ফট। সঙ্গে এক ঝাঁকানি। খুলে গেল চোখ। দেখলাম। দেখলাম, অসংখ্য বক্ররেখা। রেখাগুলি এঁকেছে কাপড়চোপড়ের তীব্র প্যাঁচ। যার আর্ত জটিলতার মধ্যে রেখায়িত এক শরীর। অনবদ্য। বঙ্কিম। কোমল। মসৃণ। বুক ঢিপ ঢিপ করছে আমার। এই তো, এই তো দেখতে পাচ্ছি। চোখ আমায় ছেড়ে যায়নি তা হলে! আমি তা হলে ডুবে যাচ্ছি না! এই তো রেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে আমি ভেসে থাকতে পারছি। আমি পারছি। এবং আমি পারছি।
কারখানার কাজ আজকের মতো শেষ। এখন বাড়ি ফিরছি দুরু দুরু বুকে। আসার পথে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ছিলাম কয়েকটা স্টোন চিপস। এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। ব্লেড আর আলপিন এখন ঘরে নেই দিদির কারণে।
অন্য দিনের মতো আজ আর সরাসরি বাড়ি ঢুকলাম না। গলির এক ধারে বহু দিনের পুরনো পাঁচিলটা শ্যাওলা ধরা, চলটা ওঠা, মাঝে মাঝে ইট বের করা, সেই পাঁচিলে চালিয়ে দিলাম স্টোন চিপসের ধারালো দিক। একের পর এক আঁকাবাঁকা রেখা বয়ে যেতে লাগল পাঁচিল বেয়ে। |
(সমাপ্ত)
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|