|
|
|
|
|
|
|
প্রতিমা চালচিত্র ভাসান |
পুজো আসছে। পুজো চলে যাবে। পুজো থাকবে। রংগন চক্রবর্তী |
প্রতিমা |
বাছতে কেউ বলেনি। লরি করে প্যান্ডেলে নিয়ে যাওয়ার কোনও দায়িত্ব নেই। তবু প্রতিমা খুঁজছিস তুই। জীবনের কাছে প্রতিমার বায়না তো কত দিন আগেই করে রেখেছিস। লোকে বলে সেই প্রথম দাড়ি বেরনোর কালে। কিন্তু তোর মনে একটা ধারণা আছে, বায়নাটা শুরু হয়েছিল তারও অনেক আগে, তবে সে নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল, ছোটদের অসুবিধে হবে। এই বায়নায় দরদামের কথা হয়নি অবশ্য। হওয়ার কথাও নয়। কোনও কুমোরের বাপের সাধ্যি নেই এই প্রতিমা বেচবে। বেচলে সেটা তো আর ঠাকুর থাকে না, পুতুল হয়ে যায়। প্রতিমা তো খেলার জিনিস নয়। বোকা পুরুষেরা অনেকে জানে না। কিন্তু তুই তো জানিস। তাই তুই আজও বসে বসে প্রতিমা দেখিস। ক্লান্তিহীন, শ্রান্তিহীন। এই তুই তো সেই লোকটা, যাকে কোনও ফিল্ম প্রথম দু’মিনিটের মধ্যে টানতে না পারলে ঘুমিয়ে পড়ে, পুজো সংখ্যা মুখে চেপে আবার সেই ঘুম। প্রায় সব লোকজনকে এত বোরিং লাগে বলে তুই মিশতে চাস না কারও সঙ্গে। অথচ সেই তুই প্রতিমা দেখিস। জীবনের ৫০টা পুজো পেরিয়েও তোর উৎসাহে ভাটা পড়ে না। কেন রে?
|
|
আর কত রকমের যে প্রতিমা! কেউ রোগা, কেউ ঢলোঢলো, কেউ নিজেকে নিয়ে নার্ভাস, কারও খড়কুটোর ওপর নতুন মাটি পড়ার এঁটেল গর্বে শরীর টানটান। কারও এখনও তেমন কেউ দোসর নেই বলে উৎসুক ইদিক উদিক চাওন। আবার কেউ কাউকে চায় না, কেবল নিজেকে নিয়ে হেঁটে যেতে পারলে বাঁচে, নিজের বা পরের চাওয়ার লজ্জা সে সামলাতে পারবে না। কারও মোবাইলের ওপারে কেউ আছে, এপারে সবাইকে জানাতে জানাতে চলেছে। তুই সবাইকে দেখছিস। আর কী একটা আশ্চর্য ভাল লাগা, কী রকম কান্না কান্না, খুশি খুশি ভাব তোর গা বেয়ে, মন বেয়ে বয়ে যাচ্ছে। এটা কিন্তু ঠিক আবার এই শরতের রোদটা না হলে হয় না। বিজ্ঞানে তুই এত অশিক্ষিত যে, কেন? সেটা ভাবতেও পারবি না।
অনেক দিন আগে একটা সময় ছিল, যখন তোর শরীরে জেগে উঠেছিল একটা নতুন সত্য যুগ। (লিখতে গিয়ে একটা সস্তা মজার লোভ তুই সামলাতে পারছিস না আচ্ছা, মল্লিকা বনে যখন প্রথম ধরেছে কলি, সেটাই কি কলি যুগের শুরু?) যাক গে, সেই যুগে তোর আস্পর্ধা ছিল অত্যন্ত বেশি, দু’টি প্রতিমাকে পাশাপাশি দেখলে ভাবতিস কোনটার জন্য বায়না দিবি, কোন জনের আরাধনায় তোর বেশি মোক্ষ লাভ হবে। এখন আর তুই সে সব ভাবিস না। এখন তোর শরীর অনেক বেশি শান্ত। মন জানে যে তুই কোন দেবীকে চাস তাতে কিছু আসে যায় না। কোন দেবী বর দেবেন, সেটাই আসল। ছেলেরা জানে না তারা বর হয় না, তারা বর পায়। সেই পাওয়ার জোরেই তাদের বর নাম হয়, জীবনের ব্যাকরণে এটা কী ভাবে ঘটে জানা যায় না, কিন্তু ঘটে। দেবীর দেওয়া বরের ধারায় পূর্ণ হওয়াই পুং জীবনের একমাত্র সার্থকতা বলেই ছেলেদের ‘পাত্র’ বলে।
হঠাৎ আবার দেবীর নানান রূপের গল্পগুলো পড়ছিস তুই মন দিয়ে। তোর মনে হচ্ছে, পাগলা ভোলা শ্মশানবিহারী শিবের সুপাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা কী আসলে নানান লোককাহিনিকে নিয়ে উচ্চ মার্গীয় আখ্যান বানানোরই আর্যমার্কা দিক?
নারী-পুরুষের নানান উদ্দামতা, যার সবটাই আবার নারী-পুরুষের প্রেমের গল্পই কেবল নয়, ধরে ধরে জোর করে পরিবারের গল্পে পুরে দেওয়া হয়েছে। যেন বেঙ্গালুরুতে পোস্টেড মেয়ে-জামাই-নাতি-নাতনি পুজোর ছুটিতে বেড়াতে আসছে।
সত্যিকারের দেবী তো কোনও দিন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার বা এম বি এ পাত্র নিয়ে মাথা ঘামায়নি। সে নিজের আর পরের শরীর নিয়ে যে সব কাণ্ড করে বেড়িয়েছে, তা নিয়ে বেশি কথা বললে সামাজিক অশান্তি বেধে যাবে। নিরীহতম আখ্যানেও সেই দেবী ভালবেসে বেছে নিয়েছিল পাগলা ভোলাকে। ঘরে বাইরে কত কথা শুনতে হত, মা বাপের কত অপমান! তবু সে তো জানত, প্রেম আর কামের সত্যিকারের যোগ্যতা কাকে বলে। সে জানত গাড়ি বা বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাটের ই এম আই-এর জন্যে উপোস করে কোনও হ্যানো-ত্যানো-ন্যানোর মাথায় জল ঢালার কোনও মানে নেই। সেই ভোলা যখন তাকে বলল দক্ষযজ্ঞে যেতে দেবে না, তখন বরকে ভয় দেখানোর জন্যে সতী যে রূপগুলো নিয়েছিল, তোর তো পরিষ্কার মনে আছে। গড়গড় করে বলে যেতে পারবি: কালী, তারা, ষোড়শী, বগলামুখী, ভৈরবী, মাতঙ্গী, কমলা, ছিন্নমস্তা, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী। আর কী সব তাদের রূপ আর গল্প।
সেই গল্পের আগেও তোর মনে পড়ে গিরীশচন্দ্র ঘোষের ‘দক্ষযজ্ঞ’ নাটকে সতীর সেই কথা, শিব যেতে পারবে না বলে সে নারী হয়ে যজ্ঞ ভাগ নেবে। এই অধিকার সে ছাড়বে কেন? ফেমিনিজম কিন্তু আজকের নয়, এ কথা তুই জানিস।
আর সেই দশটি দেবী, কী আশ্চর্য তাদের উদ্ভবের কাহিনি। কেউ কালো, গুরু নিতম্বিনী, বিশাল পয়োধরী, বিপরীত বিহারিণী, কেউ বা ধূসর বিধবা বৃদ্ধা, তার হাতে কুলো, কাক তার বাহন। কারও এক হাতে গদা অন্য হাতে টেনে ধরা অসুরের জিভ, কেউ বা কিরাটিনী।
সত্যি, কত রকমের যে নারী কল্পনা। ছাঁচে ঢালা নয়, এক রকম শরীর টেনে র্যাম্পে হাঁটা নয়, এক-গন্ধা, এক-মাপিনী, এক-হাই হিলা, এক-সাইজ জিরোর বাজার মিছিল নয়। তারা আপন ছন্দে আপন আনন্দে মাতোয়ারা, নানান আনন্দের ঝর্না ধারা, কখনও বা নিজের মুণ্ডু কেটে ছুটিয়ে দেওয়া খুনের ফোয়ারা। সেই রক্ত আবার ফিনকি দিয়ে পড়ছে দুই সখীর মুখে, কী কাণ্ড? সেই রক্তধারাকেই আবার ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, সন্তানের খিদে মেটানোর জন্য মায়ের আত্মরস বলে!
সত্যি, মেলাবেন তিনি মেলাবেন, ঝোড়ো খুন আর স্তন্য ধারায় মেলাবেন! কী সর্বশক্তিমান এই সংসার আর পরিবার-প্রতিষ্ঠান! সব কিছুকে কেমন ছকে ফেলে দেয়!
|
চালচিত্র |
অনেক দিন আগে যখন তোর শরীরটা বিপ্লবী ছিল, তখন তোর মনটা ছিল আদর্শবাদী। এখন তোর ধারণা আদর্শবাদ ব্যাপারটার মধ্যে একটা গণ্ডগোল আছে, কিন্তু এখন যেহেতু বদল বা বদলা কোনও দায়ই তোর আর তেমন ভাবে নেই, কারণ সময় কম পড়িয়াছে, তাই অনেক নতুন ভাবনাগুলো শুধু নিজের মধ্যেই ভাবিস। এগুলোর একটা হল, আদর্শ আর অস্বীকারের সম্পর্ক।
আদর্শ মানেই কেন অধিকাংশ সময় যা ভাল লাগে তাকে অস্বীকার করতে হবে? এর থেকে কি একটা অসম্ভব হিংস্রতা জন্ম নেয় না? এই বোধটা পুজোর কলকাতার সঙ্গে তোর সম্পর্কটাকে একেবারে বদলে দিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন বন্যা হলে রাগ করে তুই প্যান্ডেলে যেতিস না। নিজের জামাকাপড়, কিছু টাকা বন্যা ত্রাণে দিয়ে পুজোর থেকে দূরে সরে থাকতিস। ভাবতিস, এক দিকে যখন এত দুঃখ, অন্য দিকে কেন এত অপচয়? এই ভাবনাটা ভুল কি না, তুই এখনও জানিস না, কেউ এ রকম ভাবলে তার মত বদলানোর প্রয়োজনও তোর নেই। কিন্তু তোর নিজের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ধাক্কা লেগেছিল অনেক বছর আগে এক ভাসানের দিন।
ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপরে সে-দিন একেবারে গরিব মানুষের ঢল। সত্যিই গরিব, প্রায় কারও গায়ে নতুন জামা ছিল না। বাচ্চা, বুড়ো, জোয়ান, মহিলা। দক্ষিণের গ্রাম থেকে তারা এসেছিল ভাসান দেখতে। ওই ব্রিজের ওপর দিয়ে অনেক ভাসান যায়, তার অপেক্ষায় ছিল তারা।
দাঁড়িয়ে গিয়েছিলি তুই। দেখেছিলি কী করে ওই অন্ধকারে বেঁচে থাকা মানুষগুলো শুষে নিচ্ছে ভাসানের লরির আলো আর জেনারেটরের বিষ ধোঁয়া। তারা ত্রাণ চাইতে আসেনি। প্রাণ গিলে নিতে এসেছে। ওই কয়েক ঘণ্টার আলো মনের মধ্যে বয়ে নিয়ে তারা ফিরে যাবে তাদের অন্ধকারে। কিন্তু জেনে যাবে, আলো বলে একটা জিনিসের কাছে তারা পৌঁছেছিল। দুনিয়ায় আলো আছে। সেই বিশ্বাস ল্যাম্পপোস্টের মতো দাঁড়াবে তাদের পথের দু’ধারে। মরীচিকার মতো পথ দেখাবে, তাদের প্রতিদিন।
তার পর থেকে কলকাতার মতোই তুইও হয়ে উঠলি পুজোর চালচিত্র। হিসি-ভাসা গলি ঢেকে যখন জ্বলে ওঠে চন্দননগরের আলো, বাসি চপ যখন চুড়বুড়িয়ে হিসহিসিয়ে ওঠে নতুন তেলে, বিহারি বউটির কপালে যখন জ্বলে ওঠে কমলা সিঁদুর, তার দু’সাইজ বড় জরির চটি আর আলপনা-পায়ে যখন চলে চাপান-উতোর, তখন তুই পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়িস এই বদলে যাওয়া, খুশি হয়ে ওঠা, রাত জাগা, ভদ্রতায় বিশ্বের নম্বর ওয়ান পদক পাওয়া শহরের বুকে। ঢেউ ভাঙিস, ঢেউ হোস, দাপাস।
শেষ যুদ্ধ যদি সত্যিই কোনও দিন শুরু আর শেষ হত, এ পৃথিবীকে এ নবজাতকের বাসযোগ্য করে যাওয়ার মতো আবহাওয়া যদি সত্যিই কল্পনা করা যেত, তবে তা কি হত না সপ্তমী রাতের কলকাতা? কোটি কোটি লোকের জড়াবড়ি উষ্ণতা, সুখী ঘাম আর পারফিউমের মেশালি নেশা, কী অকল্পনীয় নিরাপত্তা। কে যেন লিখেছিলেন না, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। কলকাতা প্রতি পুজোয় ঠিক সেই স্বপ্নটা দেখায়। |
ভাসান |
স্বপ্নই তো। পুজোর মতো এত বড় মিথ্যে তো আর কিছু নেই। তার পুরোটাই তো চার দিনের চালাকি, বছরভরের ফাঁকিগুলোকে লুকিয়ে, ঢেকে, রং চড়িয়ে। কিন্তু সেটাই তো তার জোর। বস্তুবাদীরা এই কথাটা বুঝতে পারেনি বলেই কি ধর্ম ব্যাপারটাকেই তারা ধরতে পারল না?বড্ড সহজ করে দেখে ভুল করল। সত্যটা বিচ্ছিরি আর ম্যাড়মেড়ে বলে মানুষ যে বিশ্বাসে আশ্রয় নেয়, তাকে সত্যি/মিথ্যে দিয়ে মাপা যায় কি? নাকি সেই আশ্রয়টাকে বোঝার জন্যে এই তর্কের বাইরে একটা কোনও বোধ দরকার?
পুজো আসে পুজো যায় আর তুই বসে বসে ভাবিস, পুজোটা পুজোর জন্যেই দরকার, তার চেয়ে বড় কিছুর জন্যেও নয়, আবার তার চেয়ে ছোট কিছুর জন্যেও না। এই পুজো কোনও উত্তরণের আকাঙ্ক্ষামাখা উচ্চারণের জন্য আয়োজিত যজ্ঞ নয়, পুজো নিজেই একটা উত্তরণ। চার দিনের এই খুশিয়ালিই একটা জনগোষ্ঠীর মনোকামনা পূরণ। এই চার থেকে সাতটা দিন একটা বিপন্ন, নানান ঝামেলায় ডুবে থাকা শহর নিজেকে কৈলাসের উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। বাকি বছরটা এই উচ্চতায় আবার ফেরার প্রণতিমাখা দিন যাপন।
ক্ষণকালের ছন্দ এই আনন্দের আবশ্যিক শর্ত। তাই ভাসান এত জরুরি। কারণ, পুজোর এই প্রতিমাকে এই শহর ধরে রাখতে চায় মনের আসনে, আগামী বছরের নতুন চেহারায়। গাছের নীচে পড়ে থাকা, গলে যাওয়া অসম্মান নিয়ে নয়। কারণ, সে তো আবার সেই প্রতি দিনের ক্ষয়ের জয়, যে ক্ষয়কে এই শহরের চেয়ে আর ভাল কে চেনে? প্রতিদিনের এই ক্ষয়কে হারাতেই তো এই চার দিনের পুজো। পুজো তো নয়, যেন পাখা ওঠা পিঁপড়ের আগুনখেকো নাচ। পিঁপড়ে পুড়বে, কিন্তু সেই নাচকে পোড়াবে কোন আগুন?
ঝপাং।
প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে লুঠেরার দল। তোর মনে ভাসে কোনও শ্মশানে চেনা প্রতিমার কান থেকে সোনা খুলে নেওয়ার সেই অশ্লীল ছবি।
তোর জীবনে কোনও পণ নেই, সোনা নেই। গলানো সোনা দশ গ্রামের দাম সাতাশ না আঠাশ হাজার হল, তুই খবর রাখিস না। তোর শুধু মনে হয়, থাক না ওইটুকু, ওই কানে। আগুন তো সবই জ্বালিয়ে দেবে, জল তো সবই গলিয়ে দেবে। কী হবে আর অলঙ্কার সংরক্ষণে।
এই সব বসে ভাবিস। পুজো আসে পুজো যায়। গলার কাছে কী যেন একটা ঠেলে ওঠে। শোলার কাজ ধুলোয় লুটোয়। পাশের প্যান্ডেলে বাঁশের কাঠামো পড়ে থাকে অনেক দিন। প্রতিবেশীরা রাগ করেন, কবে যে এরা খুলবে। কিন্তু ওই প্যান্ডেলে মাখা থাকে পুজোর রেশ। বারান্দায় বিকেল বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে।
|
ভাগ্যিস |
চিরকালের অবিশ্বাসী তুই, তাই তোর নিজেরই বিশ্বাস হয় না যে, তুই কারও একটা কাছে প্রার্থনা করছিস, আসছে বছর যেন থাকি। চোখে জল নাকি, মোছ। ছি। ছি। এ আবার কী কথা!
আচ্ছা, তুই কি সত্যিই বিশ্বাস করিস, এই চার দিনের গল্পটা আসলে একটা বহমান সময়-সমাজ-যুগের মধ্যে আমাদের এক একটা জীবনের দু’দিনের আসা-যাওয়ার গল্প? তাই এত টান!
আমি জানি, তোর একটা ধারণা আছে যে খেলা বা অনুষ্ঠান জীবনের প্রতীকী গল্প বলে, সে আমাদের বড় কাছের হয়ে ওঠে। তুই বিশ্বাস করিস, নানা পণ্ডিত নানা কথা বললেও ফুটবল থেকে সরে এসে মধ্যবিত্ত বাঙালি যে ক্রিকেটকে জড়িয়ে ধরেছে, তার একটা সামাজিক কারণ আছে। সবাই মিলে দেওয়ানেওয়া করে এগিয়ে গিয়ে গোল দেওয়ার জীবনের গল্পের মধ্যে আমরা আর বাস করি না। ‘ধন্যি মেয়ে’র ফুটবল টিম ভেঙে গিয়েছে। এখন আমরা প্রত্যেকেই একলা সৌরভ। পরের ডেলিভারিটাতেই আউট হয়ে যেতে পারি। ড্রেসিং রুমে নানান দলাদলি। অনেকই আমার চাকরিটার জন্যেই ইন্টারভিউ দিচ্ছে। তবু তার মধ্যেই দেখাতে হবে আমার স্পর্ধা। স্টেপ আউট করে বলটাকে গ্যালারিতে ফেলতে হবে। মতি নন্দীর পায়ের কাছে।
এ ভাবেই বোধ হয়, কাঠামোতে মাটি পড়ে। লাগে জীবনের রং। গরিব অনেক মানুষ মিলে বিল থেকে তুলে আনা শোলা, রাংতায় সাজায় প্রতিমাকে। সাপের বিষ জয় করে ফুটে ওঠে নৈবেদ্যের নীলপদ্ম। মা আসেন প্যান্ডেলে। ঠিক যে ভাবে টানা রিকশায় প্রসূতিসদনে পৌঁছয় জলভাঙা জননী, রোজকার জাতকের গল্পে। দু’দিনের কাঁদা-হাসা পাগলা বর আর বিয়ের গল্প, বাপের বাড়ি ফেরা! কী সব ভয়ঙ্কর অসুর মেয়ে নাকি তাদের হারাবে। এই ঘিরেই আলো, এগ-চিকেন রোল, লাউয়ের সস। অপু, আমায় পুজোয় এক বার কাপের আইসক্রিম খাওয়াবি?
এর পর জীবনের শেষ সত্যের মতো আসে ভাসান। কলিকাতা চলিতে থাকে নড়িতে নড়িতে। ডুবুরি বাচ্চাগুলো মায়ের মুকুট বেচে ড্রেনড্রাইট শোঁকে কি?
পুজোর নেশা নিয়ে তুই বসে থাকিস তোর একলা বারান্দায়। ভাগ্যে নেশা বঙ্গে ছিল। কী দুর্দশাই হত তা না হলে!
|
ছবি: অমিতাভ মালাকার |
|
|
|
|
|