...সময় এল কাছে
আদিবাসী চিত্রকলা থেকে জীবনের বিবর্তন

ভাবতে পারি, ভাবাতে পারি!
এমনই দাবি উদ্যোক্তাদের। থিম পুজোয় দক্ষিণের আধিপত্যকে এ ভাবেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে পূর্ব কলকাতার কাদাপাড়া, কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান, বেলেঘাটা এলাকার পুজোগুলি। তাঁদের দাবি যে স্রেফ মুখের কথা নয় তার প্রমাণ মিলছে তাঁদের প্রস্তুতিতেও।
কাঁকুড়গাছি মোড়ের কাছে স্বপ্নার বাগান বিষয় ভাবনা ও প্রয়োগে শহরবাসীর কাছে ব্যতিক্রমী হিসাবেই চিহ্নিত হতে চলেছে। উৎসবে আর্থিক বৈষম্যের ভেদরেখা মুছে সকলেই সমান। সেই ভাবনাতেই থিম ‘বড় মানুষ, ছোট মানুষ।’ প্রথাগত মণ্ডপ, প্রতিমার ধারণা থেকে বেরিয়ে ছোট্ট গলি ভিন্নরূপে সেজে উঠছে। ছোট-বড় পুতুল, বাঁশ, বেসিন পাইপ, মাটির ঝাঁপি, এলইডি, রঙিন ছাতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এই ভাবনা। উদ্যোক্তারা জানান, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও সঞ্চয়ের জন্য বড় কিংবা ছোট মানুষের লড়াইয়ের পাশাপাশি মাতৃ আরাধনায় মানুষের মাঝে ভেদরেখা মুছে যাওয়ার দৃশ্যও ফুটে উঠবে। শুধু মণ্ডপ কিংবা আশপাশের বাড়িগুলিই নয়, ছোট্ট রাস্তাটিও রঙিন হয়ে উঠবে। মণ্ডপের সামনে একটি জলাধারের মাঝে প্রতিমার প্রতিফলনের ব্যবস্থা হয়েছে।
কাঁকুড়গাছি এলাকার জনপ্রিয় পুজোগুলির অন্যতম মিতালি। রজতজয়ন্তী বর্ষে তাদের থিম ‘হাতের মুঠোয় স্বর্গ’। থার্মোকল, শোলা, প্লাই, বাঁশ, নানাবিধ গাছের ফল, দড়ি দিয়ে স্বর্গের ছবি ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। ভিন্নধর্মী মণ্ডপ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। উদ্যোক্তাদের দাবি, স্বর্গের পরিকল্পনা ফুটিয়ে তুলতে আলোকসজ্জায় থাকছে চমক।
বাগমারি ইয়ুথ প্রোগ্রেসিভ অ্যাসোসিয়েশন শারদোৎসবে লোকশিল্পীদের পসরা নিয়ে হাজির, যা রীতিমতো চমকে দিতে চলেছে শহরবাসীদের। মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়ারার পাতালকোটের ভারিয়া জনজাতিদের তৈরি কাঠের মুখোশ ও গোন্ড জনজাতির বর্ণময় ভিত্তিচিত্র নিয়েই তাঁদের এ বারের পরিকল্পনা। পাতালকোট ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফুট নীচে। বৃক্ষ ও মাটিকে দেবতা ও মাতৃজ্ঞানে পুজো করে। মাত্র ৪ জন শিল্পী এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছেন বলে দাবি উদ্যোক্তাদের। সেই শিল্পীরাই এখানে এসে কাজ করছেন। গোলাকৃতি মণ্ডপটি অনেকটা ধানের গোলার মতো। মণ্ডপে প্রবেশের জন্য রয়েছে ১২০ ফুট লম্বা প্রবেশ কক্ষ। সেখানে বর্ণময় গোন্ড চিত্রকলার সম্ভার। প্রবেশমুখের আগে দুটি তোরণে ভারিয়া ও গোন্ড আদিবাসীদের চিত্রকলার যুগল মিলন। যেখানে আদিবাসীদের দেব-দেবী থেকে সমাজ জীবন ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে।
গত বেশ কয়েক বছরে নিজস্ব চিন্তাধারার প্রতিফলনে থিমের জগতে এলাকায় সুনাম অর্জন করেছে কাঁকুড়গাছি আবাসিকবৃন্দ। সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে অবশ্য ফিরে যাওয়া পুরাণে। বিষয় একান্ন পীঠ। তবে নিছক একান্ন পীঠের বিবরণই নয়, মণ্ডপসজ্জা থেকে প্রতিমার অলঙ্করণে পুরাণ ও আধুনিকতার মিশেল। উদ্যোক্তারা জানান, একান্ন পীঠ সম্পর্কে বর্ণময় তথ্য সম্ভারের পাশাপাশি মণ্ডপ সজ্জা থেকে প্রতিমায় আধুনিক শৈলীর প্রয়োগ থাকবে।
থিম পুজোর ভিড়ে না থেকেও জনপ্রিয় কাঁকুড়গাছি যুবকবৃন্দ আশিতম বর্ষে রাজস্থানের বিড়লা মন্দিরের অনুকরণে মণ্ডপ করছে। প্রতিমাও সেই আদলেই। মণ্ডপ হবে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। আলোকসজ্জায় থাকবে চমক। কাঁকুড়গাছি কেআইটি বিল্ডিং ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (৫, ৬ ও ৭) প্রাক্-সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে অ্যাদ্যাপীঠের অনুকরণে মণ্ডপ ও সাবেক পুজো নিয়ে হাজির শারদোৎসবে।
পশু সংরক্ষণ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা ১৪ পল্লি সাধারণ দুর্গোৎসব কমিটির। গোটা পরিকল্পনা তৈলচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা। কাদাপাড়া সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির পুজোয় বারো মাসে তেরো পার্বণকে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। প্রতিমায় ডাকের সাজের সাবেকিয়ানাই বিশেষত্ব।
গত কয়েক বছরে ভিন্নধর্মী চিন্তাভাবনায় চমক দিয়েছে নবোদয় পল্লিমঙ্গল পুজো কমিটি। তাদের এ বারের ভাবনায় জীবনযাত্রায় বিবর্তন। মণ্ডপে বিভিন্ন ম্যুরালের পাশাপাশি ভাস্কর্যের ব্যবহার এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবে। পিরামিডের মতো আকারে ম্যুরালগুলি থাকবে। প্রতিমা সাবেক। বাণী সঙ্ঘ, কেআইটি বিল্ডিংস রেসিডেন্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (১-৪), কেআইটি পল্লি (স্কিম-৬এম) দুর্গোৎসব কমিটি, নারকেলডাঙা শীতলাতলা সর্বজনীন, বাগমারি বাজার সর্বজনীন, বাগমারি নবারুণ সঙ্ঘের পুজোতে এ বারেও মানুষের ঢল নামবে বলে দাবি উদ্যোক্তাদের।
কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগানের মতো বেলেঘাটা, নারকেলডাঙা ও মেট্রোপলিটন বাইপাস এলাকাও একই ভাবে থিমের দৌড়ে রয়েছে।
মানুষের জীবনে চক্রবৎ আকারে উত্থান-পতন অবশ্যম্ভাবী। ৩৩ নম্বর পল্লি অধিবাসীবৃন্দের এ বারের ভাবনায় তাই থিম হল ঢেউ। মণ্ডপসজ্জার প্রতি পর্যায়ে সেই পরিকল্পনার ছাপ। মূল ফটক দিয়ে সিঁড়ির ব্যবহার। যেখানে যতটা উপরে ওঠা ততটাই নীচে নেমে মূল মণ্ডপে প্রবেশ। আবার মণ্ডপের মধ্যে তরঙ্গের আছড়ে পড়ার দৃশ্য।
আশিতম বর্ষে আলোর চমক দিতে চলেছে বেলেঘাটা নবমিলন। তাদের থিম: আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও। গোটা মণ্ডপই সেজে উঠবে সাজবাতির আকারে নানা ধরনের কাপড় দিয়ে। প্রবেশমুখ থেকে মন্দির পর্যন্ত দু’-আড়াইশো কাপড় দিয়ে মোড়া আলোকসজ্জা। পার্ল, এলইডি বাল্ব ব্যবহার করে আলোকসজ্জায় থাকছে চমক।
মায়ানমার বজরার প্রতিযোগিতাকে ভিত্তি করে ৪২তম বর্ষে সন্ধানীর পরিকল্পনায় বজরায় দুর্গা। কৃত্রিম জলাধারের মধ্যে বিশালাকার একটি বজরা। তার মধ্যেই প্রতিমার আরাধনা। মণ্ডপসজ্জায় মায়ানমারের বজরার বিভিন্ন শিল্পরীতি ফুটে উঠবে বলে জানান উদ্যোক্তারা।
৬৩তম বর্ষে বিবেকানন্দ সঙ্ঘের পরিকল্পনায় সৃষ্টির উপাখ্যান। ফোম, শোলা, বিভিন্ন মডেল ও আলোকসজ্জায় ফুটিয়ে তোলা হবে এই ভাবনা। দুর্গারূপে পিতলের প্রতিমা অস্ত্রহীন। সেখানে অন্য কোনও প্রতিমার দেখা মিলবে না।
পূর্ব কলকাতা ছাত্র সমিতির পুজোয় এ বার বৌদ্ধ সংস্কৃতি। নয়নাভিরাম প্যাগোডা এবং সেই আদলে প্রতিমা। বেলেঘাটা খালপুল সংহতির পুজোয় প্যাগোডার অনুকরণে মণ্ডপ ও সেই আদলেই প্রতিমা।
কুমারী পুজো, কাঁধে করে নিরঞ্জনের মতো প্রথা নিয়ে এ বারেও সাবেক পুজোয় শুঁড়া যুবকবৃন্দ। পাশাপাশি শুঁড়া স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোয় মন্দিরের আদলে মণ্ডপ। তাতে টেরাকোটার কাজ। প্রতিমা সাবেক। গুরুদাস পার্ক, ধীরেন চারু স্মৃতি সঙ্ঘ, মুক্তি সঙ্ঘ, মিত্র সঙ্ঘ থেকে মেট্রোপলিটন সর্বজনীনের পুজো দর্শনার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে চলেছে বলে উদ্যোক্তাদের দাবি।

ছবি: অর্কপ্রভ ঘোষ




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.