খিদিরপুর উত্সবের আলোয় সেজে উঠছে । প্রতি বছরই এখানে সহাবস্থান থিমের সঙ্গে সাবেকিয়ানার।
খিদিরপুর পল্লি শারদীয়ার মণ্ডপে নবদুর্গার ন’টি রূপের ন’টি রং ফুটে উঠছে। প্লাই, লোহার জাল, রুটি তৈরির জাল আর সমুদ্রের ফেনা দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। আলোর সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হবে রঙের খেলা। এখানে প্রতিমা সনাতনী রূপে সাদা শাড়িতে সজ্জিতা। বাহন সিংহ ঘোড়ার আদলে।
‘রং যেখানে আলোয় মিশেছে’ বিহারের বিভিন্ন উৎসবে রং আর শোভাযাত্রা বিশেষ আকর্ষণীয়। সেই রং ও আলোর মেলবন্ধনে তৈরি হচ্ছে খিদিরপুর ২৫ পল্লি ক্লাবের মণ্ডপ। বিহারের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন শোভাযাত্রার দেখা মিলবে এখানে। মূলত বাঁশের কাঠামোর উপর জাল আর নানা রঙের চুমকি বসিয়ে তৈরি হচ্ছে মাছ, ময়ূর, পাখি, কচ্ছপ, গ্রামের গৃহবধূ আর দেব-দেবীর প্রতিকৃতি। তবে এ বার এই পুজোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য মণ্ডপসজ্জার সামগ্রী হিসেবে আলো ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিমাও তৈরি হচ্ছে মণ্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
“সঞ্চয়ই ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎই সঞ্চয়”। বিভিন্ন আকারের প্রায় হাজার তিনেকের উপর লক্ষ্মীর ঝাঁপি দিয়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছে খিদিরপুর নবরাগ ক্লাব। ঝাঁপির উপর নানা রং দিয়ে আঁকা থাকবে কালীঘাটের পটচিত্র। প্রায় দশ ফুট উচ্চতার প্রতিমাও তৈরি হচ্ছে কালীঘাটের পটের আদলে। পুজো উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, বর্তমানে যে হারে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে তাতে প্রতিটি মানুষের সঞ্চয় আবশ্যিক। তাই এ বার তাঁদের ক্লাবে দেবী আসছেন ধন-সম্পদ রক্ষাকর্ত্রী হিসেবে।
চিনা শিল্প এ বার মণ্ডপসজ্জায়। কাঠের বাটাম, বাঁশ, মার্কিন কাপড়, রং আর থার্মোকল দিয়ে তৈরি হচ্ছে চিনা প্যাগোডা। আর সেই প্যাগোডার ভিতরে এক-একটি দেওয়াল জুড়ে থাকছে ড্রাগন, লাফিং বুদ্ধ আর চিনা ডং। মণ্ডপের ভিতরে থাকছে ছ’-সাত ফুট চওড়া জলাশয় আর উপরে থাকবে থার্মোকলের তৈরি বড় ঘণ্টা। আনা হচ্ছে পেলিং থেকে বিশেষ ধরনের চিনা আলো। তবে প্রতিমা এখানে বরাবরের মতো সাবেক।
খিদিরপুর উদয়ন ক্লাবের মণ্ডপ তিনটি ভাগে বিভক্ত। ঢোকার মুখে মণ্ডপের চূড়া হবে শিবলিঙ্গের আকারে। পরের অংশটি হবে পদ্মফুলের আকারে। মূল মণ্ডপের চূড়া তৈরি হচ্ছে কমণ্ডলুর আকারে। শিল্পীর কথায় দুর্গার সঙ্গে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরকে মণ্ডপে তুলে ধরতেই তাদের চিহ্নস্বরূপ মণ্ডপের চূড়া এ ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। মণ্ডপের ভিতরে আর বাইরে দেওয়াল জুড়ে কাপড়ের ক্যানভাসের উপর আঁকা থাকবে দেবীকে অস্ত্রপ্রদানের ছবি।
“লাল মাটি ধুনোধূপ সঙ্গে মায়ের নবরূপ” বাঁকুড়ার পুরনো মন্দিরের আদলে খিদিরপুর ৭৪ পল্লির পুজো মণ্ডপ। প্লাস্টার অফ প্যারিস, আঠা, আর লাল সুরকি দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপের দেওয়াল। আর সেই দেওয়ালে শোলা কেটে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে দুর্গার নবরূপ। প্রতিমা এখানে মাতৃরূপে লাল পাড় সাদা শাড়িতে সজ্জিতা। হাতে শাঁখা আর পলা।
খিদিরপুর যুবগোষ্ঠীর এ বার সুবর্ণ জয়ন্তী। কাঠের কারুকার্য করা প্লাইয়ের উপর ওয়ালপেপার দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপের ভিতরের দেওয়াল। তবে মূল বৈশিষ্ট্য চন্দননগরের আলোকসজ্জা।
খিদিরপুর ৭৫ পল্লির পুজো বরাবরই সাবেক। এলাকার মানুষের দাবি মেনেই ক্লাবে থিমের বদলে পুজোর রীতিনীতির উপর জোর দেওয়া হয়, জানালেন উদ্যোক্তারা। তবে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে চার্চের আদলে। খিদিরপুর ভেনাস ক্লাবের ৬৩ বছরের পুজোয় এ বার বাংলার ঝুড়িশিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে মণ্ডপসজ্জায়। এখানকার বৈশিষ্ট্য অকালবোধন। প্রতিমা সাবেক। অর্থাৎ প্রতিমার সঙ্গে রাম ও লক্ষ্মণের মূর্তির পুজো হয়। খিদিরপুর মিলন সঙ্ঘ তাদের ৭২ বছরের পুজোয় তুলে ধরতে চলেছে “অন্ধকার শেষে আলোর উত্তরণ”। জ্যামিতিক আকারের চৌকো আর গোল টিনের পাত দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। আর পাতের পিছনদিক থেকে নানা রঙের আলোর সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে আলো-আঁধারি।
খিদিরপুর কবিতীর্থ বরাবরই সাবেকিয়ানা ধরে রেখেছে। ঊনষাট বছরের এই পুজোয় দেবী রুদ্রাণী রূপে পূজিত হয়ে আসছেন। বাঁশ, মাদুর, কাঠি আর চট দিয়ে মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে এখানকার মণ্ডপ। থিম পুজো না হলেও কবিতীর্থের ঠাকুর দেখতে লোকের ঢল নামে।
মোমিনপুর সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি তাদের ৫৩তম বর্ষে মণ্ডপসজ্জায় তুলে ধরছে রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ। বাঁশের কাঠামোর উপর থার্মোকল আর কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সহজ পাঠের নানা চিত্র। মণ্ডপের সঙ্গে তৈরি করা হচ্ছে মানানসই দেবীমূর্তি।
গার্ডেনরিচ এলাকার সব পুজোতেই থিমের ছোঁয়া। তবে পুজোর পরে দশমীর দিনে শোভাযাত্রা গার্ডেনরিচের প্রতিটি পুজো কমিটির কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। ব্যান্ডপার্টি আর নানা ধরনের সাজের শোভাযাত্রা এখানকার প্রতিটি পুজোর বড় আকর্ষণ।
গার্ডেনরিচের ফ্রেন্ডস ক্লাবের মণ্ডপ এ বার সেজে উঠছে নানা আকার ও রংয়ের পুতুলে। ছোট-বড় আকারের পুতুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে প্রবেশপথ থেকে মূল মণ্ডপ। এমনকী প্রতিমাও তৈরি হচ্ছে পুতুলের ধাঁচে।
কাল্পনিক রাজবাড়ির আদলে মণ্ডপ সাজাচ্ছে গার্ডেনরিচ মুদিয়ালি ক্লাব। তবে পুজো উদ্যোক্তাদের বক্তব্য, এ বার তাঁদের পুজোর মূল আকর্ষণ প্রতিমা। চালচিত্র নিয়ে প্রায় উনিশ ফুট উঁচু প্রতিমার সাজই মূল আকর্ষণ। গার্ডেনরিচের মুদিয়ালি জেলেপাড়ার পুজোর থিম “মা-মাটি-মানুষ”। গ্রামবাংলার একখণ্ড চিত্র তুলে ধরছে এই পুজো কমিটি।
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য ও পিন্টু মণ্ডল
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি No part or content of this website
may be copied or reproduced without permission.