এক সময়ে কর্তা-গিন্নিদের হাঁকডাক, কাজের লোকেদের দৌড়ঝাঁপ, পুরোহিত-বাজনদারদের ব্যস্ততায় পুজোর চারটি দিন গমগম করত ন’মহলা বাড়িটা। লুচি-তরকারি, মণ্ডা-মিঠাইয়ের গন্ধে ম ম করত চারপাশ। দশমীতে জোড়া নৌকায় মা দুর্গার বিসর্জন হত গঙ্গায়। আতসবাজির রোশনাই ছড়িয়ে পড়ত আকাশে।
সময়ের স্রোতে গুপ্তিপাড়ার হাটখোলাপাড়ার সেনবাড়ির সেই পুজোর আড়ম্বর আজ অনেকটাই কমেছে। তবু হুগলি জেলায় বনেদি বাড়ির পুজোগুলির মধ্যে এখনও বিশেষ স্থানে রয়েছে গুপ্তিপাড়ার সেনবাড়ি।
এ বাড়িতে চিরাচরিত ভাবে বৃহৎ নন্দীকেশ্বর পুরাণ মতে পুজো হয়। একচালার প্রতিমা। লক্ষ্মীর মাটির পেঁচা নেই। একটি আলাদা কুঠুরিতে সেখানে ৪-৫টি পেঁচা বছরভর থাকে। মোষ বলির রীতি ছিল। এখন অবশ্য আখ, কুমড়ো, কলা বলি হয় পুজোর দিনগুলিতে। বর্তমানে বংশধরেরা কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। পুজোর সময় অবশ্য সকলেরই উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠে বিশাল বাড়িটা। পালা করে পুজোর যাবতীয় খরচ বহন করেন শরিকরা। |
কথিত আছে, আনুমানিক ১৫৮৩ সালে পরিবারের তৎকালীন কর্তা রাম সেন এই পুজোর প্রচলন করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা তীর্থে বেরিয়ে এই জায়গায় বিশ্রাম করেছিলেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে কুলগুরুর নির্দেশে তাঁরা বেশ কয়েক দিন গুপ্তিপাড়ায় অবস্থান করেন। ক্রমে স্থায়ী ভাবে বসবাস আরম্ভ করেন।
রাম সেনের কয়েক পুরুষ পরে কীর্তিচন্দ্র সেন ঠাকুর-দালানটি নির্মাণ করান। অন্দরমহলে তৈরি হয় ২-৩ তল বিশিষ্ট চকখিলান মহল। গোটা বাড়িতে রয়েছে অন্তত ৫০টি ঘর। বাড়িতে ঢুকতে হয় সিংহদরজা দিয়ে।
পরিবারের লোকজন জানান, ঠাকুর-দালানের তিন দিকের ঘরগুলিতে এক সময় বাজনদার, রাঁধুনিরা থাকতেন। তামার বড় জালাতে গঙ্গাজল থাকত। বেশ কয়েক বছর আগে পুরনো অনেক কিছুই খোওয়া যায়। পরিবারের বর্তমান সদস্য অশীতিপর প্রণবচন্দ্র সেন বলেন, “বিশাল বিশাল বাসনকোসন ছিল। নৈবেদ্যর থালা তুলতে ২ জন লাগত। আড়াই মণ চালের নৈবেদ্য দেওয়া হত দেবীকে। ভোগের উপকরণে পাত্র উপছে পড়ত। এখন সে সব পরিমাণে অনেকটাই কমে গিয়েছে। ছেলেবেলায় যে পুজো দেখেছি, তার সঙ্গে এখনকার পুজোর আকাশ-পাতাল তফাত।”
আগে তিন দিন ধরে যাত্রাপালা হত। পরিবারের লোকেরাও অভিনয় করতেন। কবিগান হত। দলে দলে লোক ভিড় করতেন সেই সব অনুষ্ঠান দেখতে।
এখন আর যাত্রাপালা, কবিগান কিছু হয় না। তবু, পুজোর দিনগুলিতে এখনও সেনবাড়িতে ভিড় জমান গ্রামবাসীরা। সরগরম হয়ে ওঠে চারটি দিন। |