আপত্তি তৃণমূলের, অন্যদেরও রান্নার গ্যাসের দাম নিয়ে বৈঠক স্থগিত শরিক-চাপে
ণ্ণা-আগুন নিভতে না নিভতেই পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে এ বার রাজনীতির তপ্ত কড়াইয়ে পড়ল কেন্দ্রীয় সরকার।
বিরোধীরা তো বটেই, এ ব্যাপারে খড়্গহস্ত তৃণমূল-সহ ইউপিএ-র তামাম শরিক নেতৃত্ব। এতটাই যে, শেষ পর্যন্ত রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আজ থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হল সরকার তথা কংগ্রেস। গত কাল তেল বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলি পেট্রোলের দাম বাড়ানোর পর আজ রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমানো নিয়ে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠীর (ইজিওএম) বৈঠক নির্ধারিত ছিল। কিন্তু শরিক অসন্তোষের মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত ওই বৈঠক পিছিয়ে দেওয়া হল।
কিন্তু কত দিন?
সরকারের শীর্ষ নেতাদের মতে, গোটা বিষয়টিই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘পপুলিজম’ বা জনপ্রিয়তার রাজনীতি বনাম অর্থনীতির দ্বন্দ্ব। এক দিকে অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ধরে রাখতে ভর্তুকি কমানো ছাড়া উপায় নেই। আবার তা করতে গেলেই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সকলের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কা। কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডির বক্তব্য, পেট্রোলের মূল্য বিনিয়ন্ত্রণের জন্য গত বছর ২৫ জুন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা ছিল সময়ের দাবি। কেন না, সরকারের পক্ষে এত ভর্তুকির বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। তা হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের মতো সামাজিক প্রকল্পে সরকার অর্থ জোগাবে কোথা থেকে। তবে পেট্রোলের মূল্য নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা হলেও সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে কেরোসিন ও ডিজেলের ক্ষেত্রে এখনও তা করা হয়নি। এই দুই পেট্রোপণ্যে লিটার প্রতি ২৪ টাকা ও ৭ টাকা ভর্তুকি দিয়ে চলেছে সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে, গত বছরের ২৫ জুনের ওই বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছিলেন শরিক নেতৃত্ব। তখনই তাঁরা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারের এই সিদ্ধান্তের দায় তাঁরা নিতে নারাজ।
আক্ষরিক অর্থে পেট্রোলের মূল্য নির্ধারণ এখন বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা তেলের দাম বাড়া-কমার সঙ্গে তা ওঠানামা করে। সেই সঙ্গে কিছু পারিপার্শ্বিক বিষয়ও কাজ করে। তেল বিপণন সংস্থাগুলির বক্তব্য, গত কাল পেট্রোলের দাম বাড়ানো হয়েছে তেমনই একটি কারণে। তা হল, ডলারের সাপেক্ষে ভারতীয় টাকার দাম কমে যাওয়া। এ জন্য তেল সংস্থাগুলির ইতিমধ্যেই ২৪২৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না। প্রসঙ্গত, বিনিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্তের পর এ যাবৎ ১১ বার দাম বেড়েছে পেট্রোলের।
তবে সরকারের যুক্তি মানতে নারাজ বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, পেট্রোপণ্যের দাম বাড়ানোর সময় আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়ানোকে অজুহাত হিসাবে দেখানো হয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তার কোনও প্রতিফলন ঘটে না। কিছু দিন আগে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় দাম কমানোর ইঙ্গিত দিলেও আখেরে তা হয়নি।
পেট্রোলের দাম নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতির মধ্যে কাকতালীয় ভাবেই রান্নার গ্যাসের ভর্তুকি কমানো নিয়ে আজ মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। নন্দন নিলেকানির নেতৃত্বে গঠিত একটি টাস্ক ফোর্স ভর্তুকি কমানো নিয়ে আগেই সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করেছিল। টাস্ক ফোর্সের সুপারিশ ছিল, সম্পন্ন পরিবার পিছু বছরে ভর্তুকি মূল্যে প্রাপ্য রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের সংখ্যা চার থেকে ছ’টিতে বেঁধে দেওয়া হোক। তার পর প্রতিটি অতিরিক্ত সিলিন্ডারের জন্য গ্রাহককে ভর্তুকিহীন দাম অর্থাৎ সাতশো থেকে আটশো টাকা দিতে হবে। পেট্রোলের দাম বাড়ার পর এমনিতেই অসন্তোষে ফুঁসছিল সরকারের শরিক দলগুলি। ফলে মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠকে আজ এনসিপি প্রধান তথা কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার উপস্থিত হতেই চাননি। অন্য দিকে, মন্ত্রিগোষ্ঠীতে তৃণমূলের সদস্য তথা রেলমন্ত্রী দীনেশ ত্রিবেদী বলেন, “পেট্রোলের বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহারের জন্য আমরা দাবি জানাব। দাম বাড়ানোর আগে আমাদের জানানো হয়নি। তবে শুনেছি, রান্নার গ্যাস নিয়ে আলোচনার জন্য মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যেদিনই সেই বৈঠক হোক তাতে অংশ নিয়ে প্রতিবাদ জানাব।” তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে শরিক দল ডিএমকে-ও। তবে এই দুই দলের নেতারাই জানিয়েছেন, মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক হলে তাঁদের যাওয়ারই সম্ভাবনা। কারণ, তাতে নিজের আপত্তিটাও জানানো সম্ভব হয়।
এ দিন কলকাতায় মহাকরণে গিয়ে মমতার সঙ্গে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রীর দূত কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অম্বিকা সোনি। তিস্তা চুক্তি নিয়ে জলঘোলার সময়েই ঠিক হয়েছিল, অম্বিকা কলকাতা যাবেন। এ দিনের বৈঠকে তাঁকে পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নিজের আপত্তির কথাও জানান মমতা। পরে অম্বিকা বলেন, “আমি মমতার ক্ষোভ ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানাব। প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। আশা করব, তাঁরা কোনও পথ বের করবেন।” মমতাও পরে বলেন, “কাল আমাদের দলের তরফে মুকুল রায় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ফোনে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রোজ রোজ পেট্রোল-ডিজেলের দাম বাড়লে জিনিসের দাম বাড়বে।”
অর্থ মন্ত্রক সূত্রে বলা হচ্ছে, সরকারের অন্দরমহলে ক্ষোভের জন্যই এ দিনের মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী আর পি এন সিংহ পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বলেন, রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ানো মূল উদ্দেশ্য নয়। সরকার চাইছে ভর্তুকি মূল্যে দেওয়া গ্যাসের সিলিন্ডারের অপব্যবহার রুখতে। কারণ, গৃহস্থদের ব্যবহারের জন্য এই সব গ্যাস সিলিন্ডার বেআইনি ভাবে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কংগ্রেসের মধ্যেও কিন্তু এখন পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। কারণ, উত্তরপ্রদেশ-সহ চার রাজ্যে বিধানসভার ভোট আসন্ন। কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশের আশঙ্কা, পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হাত পুড়তে পারে। তাই জন অসন্তোষের কথা মাথায় রেখে কংগ্রেস মুখপাত্র রশিদ আলভি আজ বলেন, “অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে পেট্রোলের দাম বাড়ানো অপরিহার্য ছিল, সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু দাম কমানো যায় কি না, সে ব্যাপারে সরকারের চেষ্টা করে দেখা উচিত।”
সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে আজ কংগ্রেস কোর গ্রুপের বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। সেখানে ঠিক হয়েছে, রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি কমানো নিয়ে মন্ত্রিগোষ্ঠীর মাধ্যমেই শরিকদের সঙ্গে কথা বলা হবে। সব গুরুত্বপূর্ণ শরিকই মন্ত্রিগোষ্ঠীর সদস্য। এ ছাড়াও কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলিতে প্রয়োজনে ভ্যাট কমিয়ে পেট্রোলের দাম কমানোর কথাও ভাবছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। এ দিন কোর গ্রুপের বৈঠকে ঠিক হয়েছে, সনিয়া গাঁধীর সম্মতি নিয়ে এই ব্যাপারে কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলিকে প্রস্তাব পাঠানো হবে, যাতে তারা পারলে ভ্যাট কমিয়ে পেট্রোলের দাম কমাতে পারে। বস্তুত, তেলের দামের যে রাজ্যওয়াড়ি ফারাক, তার পিছনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ভ্যাট বা মূল্যযুক্ত করের একটা ভূমিকা থাকে। কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন চাইছেন, এই ভাবে তাঁদের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া ক্ষোভকে প্রশমিত করতে। আবার অন্য, অকংগ্রেসি রাজ্যের সামনে নজির সৃষ্টি করতে। যাতে পরে বলা যায়, অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতায় পেট্রোলের দাম বাড়লে কংগ্রেসশাসিত রাজ্যগুলি সেই চাপ মানুষের উপরে পড়তে দেয়নি।
একই সঙ্গে প্রশ্ন তোলা যায়, বিরোধীরা এই পথে হাঁটছেন না কেন?
বিরোধীরা, বিশেষ করে বিজেপি এর মধ্যেই কিন্তু তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে মাঠে নেমে পড়েছে। তারা আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করে পরোক্ষে সরকারের উপর চাপ বাড়ানো কৌশল নিয়েছে। দলের মুখপাত্র শাহনওয়াজ হোসেন বলেন, “আমরা জানি, মমতার থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। এবং কেন্দ্রের সরকারেও তিনি যথেষ্ট প্রভাবশালী। যে ভাবে প্রভাব খাটিয়ে তিনি তিস্তা জলবণ্টনের মতো আন্তর্জাতিক চুক্তি আটকে দিয়েছেন, ঠিক সেই ভাবে সরকারের উপর চাপ দিয়ে পেট্রোলের বর্ধিত দাম প্রত্যাহার করার ব্যাপারে প্রভাব খাটাচ্ছেন না কেন? শুধুমাত্র প্রতিবাদ জানিয়ে তাদের দায়িত্ব ক্ষান্ত হয় না।” মজার ব্যাপার হল, রাজনৈতিক মতাদর্শে বিজেপির সম্পূর্ণ উল্টো দিকে থাকা সিপিএম-ও আজ একই সুরে সমালোচনা করেছে মমতার। কলকাতায় সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলেছেন, “মমতা প্রতিবাদ করলে কেন্দ্র কি কোনও কাজ করতে পারে? তিস্তা জলচুক্তি বা জমি বিলের ক্ষেত্রে মমতার আপত্তিতে কেন্দ্র এগোতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে (তেলের দাম) উনি যে দরদ দেখাচ্ছেন, তা কুম্ভীরাশ্রু ছাড়া কিছুই নয়!” সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম থেকে এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসু, সকলেই কড়া ভাষায় কেন্দ্রের সমালোচনা করেন।
বিজেপি তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে সরকারের যুক্তিও খারিজ করে দিয়েছে। দলীয় নেতৃত্বের বক্তব্য, সরকারের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়, তেল সংস্থাগুলির পাহাড়প্রমাণ লোকসান হচ্ছে। অথচ গত বছর পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্র থেকে সরকারের কর সংগ্রহ হয়েছে ১ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৪০,৪৩০ কোটি টাকা। ফলে সরকারের যুক্তি ধোপে টেঁকে না। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্র বলে, এ বাবদ প্রাপ্ত রাজস্ব থেকে রাজ্যগুলিকেও প্রাপ্য ভাগ দিতে হয়। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সেই অর্থ দেওয়ার পরেও সরকারের হাতে ৪০ হাজার কোটি টাকা থাকে। তাই লোকসানের তত্ত্ব অমূলক।
বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য, সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা বৃদ্ধির পিছনে ছুটবে, নাকি ঘাটতি কমানোর দিকে নজর দেবে। দু’টো একসঙ্গে চলতে পারে না। সরকার বড় বড় শিল্পসংস্থাকে মদত দিয়ে যাচ্ছে। তাদের কর ছাড় দিচ্ছে। আর আম-আদমির উপর বোঝা বাড়াচ্ছে। শিল্পসংস্থাগুলি বড় বড় দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে আখেরে খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকেই। যখন উৎপাদন শিল্প মার খাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি চরম সীমায় পৌঁছচ্ছে, সেই সময় আম-আদমির উপর কোপ ভুল অর্থনীতি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.