নিজেদের পাড়ায় দুর্গা পুজো হত না। পুজো দেখতে যেতে হত অন্য পড়ায়। সেখানে গিয়ে শুধু প্রসাদ নেওয়া কিংবা দর্শকের মতো ঘুরে বেড়াতে হত নানুরের কীর্ণাহার স্টেশন পল্লির বাসিন্দাদের। তাই ২৫ বছর আগে ওই পাড়ায় দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন পাড়ার মুক্তাঙ্গন সর্বজনীন পুজো কমিটির সদস্যরা।
২৫ বছর আগে পুজো শুরু করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। সে সময় ওই পাড়ায় ২৫টি পরিবারের বাস ছিল। তাঁদের অধিকাংশ জীবনজীবিকার তাগিদে সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে দুর্গাপুজো চালু করার মতো ওই পাড়ার বাসিন্দাদের আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তারই মধ্যে চাঁদা তুলে কোনও রকম ভাবে প্রচলন করেছিলেন পুজো। সে সব দিনের কথা আজও মনে পড়ে তৎকালীন পুজো কমিটির সভাপতি বিষ্ণুপদ মুখোপাধ্যায়, সম্পাদক অজয় সাহাদের। তাঁদের কথায়, “অন্য পাড়ার পুজোয় নিজেদের বহিরাগত মনে হত। অপমানিত হতে হয়েছে। তাই আমরা ঠিক করলাম নিজেরাই পুজো করব। কষ্ট হলেও নিজেদের পাড়ায় পুজো শুরু করি।” |
তার পর থেকে অবশ্য পুজো চালাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি উদ্যোক্তাদের। ধীরে ধীরে স্টেশন পল্লি এলাকায় বসতি বেড়েছে। আর্থিক অবস্থাও আগের থেকে কিছু ভাল হয়েছে। বর্তমানে ওই এলাকায় ১৫০টি পরিবার বাস করেন। বধূ শুভ্রা মুখোপাধ্যায়, রুম্পা দাস, ইশানী দাসদের বিশ্বাস, “পুজো প্রচলনের পর থেকে প্রতি বছর পাড়ার কেউ না কেউ চাকরি পাচ্ছেন। অনেকের ব্যবসায় সমৃদ্ধি হচ্ছে। তাঁরাই পালা করে পুজোর খরচের একাংশ বহন করছেন।’’ এ বার পুজোর রজতজয়ন্তী বর্ষ। তাই মণ্ডপ সজ্জা থেকে থিমের বৈচিত্র অন্য পুজো কমিটিকে টেক্কা দিতে দিন রাত এক করে কাজ করছেন উদ্যোক্তারা। বর্তমান সম্পাদক অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে চলেছেন পুজো প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তথা বর্তমান পুজো কমিটির আহ্বায়ক অজয় সাহাও। বাদ নেই প্রবীণ থেকে খুদেরাও। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী অতসী দাস, নবম শ্রেণির ছাত্র টিটু ঘোষদের সঙ্গে সামিল হয়েছেন ৬৫ বছরের মহাদেব দাস, ৬৩ বছরের অজিত মল্লিকরাও।
উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, এ বার পুজোর বাজেট ধার্য হয়েছে ৬ লক্ষ টাকা। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের আদলে তৈরি হচ্ছে ৬৫ ফুট উচ্চতার পাটকাঠির মণ্ডপ। প্রতিমাতে রয়েছে থিম বৈচিত্র। মণ্ডপের ভিতর যেন বিচারশালা। আর দেবী স্বয়ং বিচারক। চিত্রগুপ্তরূপী গণেশ বিবরণ দিচ্ছেন কার কী অপরাধ। আর কোথাও শাস্তিপ্রাপ্ত, কোথাও শাস্তির অপেক্ষায় গাছে বাঁধা, আবার কোথাও দোষ স্বীকার করে জোড়হাতে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিমায় একাধিক অসুর। বিভিন্ন ভূমিকায় রয়েছেন লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকও। উদ্যোক্তাদের দাবি, সন্ত্রাস, হিংসা-সহ বিভিন্ন অশুভ শক্তির প্রতিমূর্তি স্বরূপ ওই সব অসুরদের বিচার দৃশ্য সকলকে আকৃষ্ট করবে। পুজোর চার দিনই রয়েছে, কবিগান, ভাদু, বাউল, নাটক কীর্তন-সহ নানা অনুষ্ঠান। অষ্টমীতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। রজতজয়ন্তী উপলক্ষে পুজোর চার দিন পাড়ায় কার্যত কোনও বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না। এলাকার অনাথ-আতুরদের সঙ্গে পঙক্তি ভোজে সামিল হবেন প্রতিটি পরিবার। সেই ভোজে সামিল হতে মুম্বই থেকে বিমল মুখোপাধ্যায়, দিল্লি থেকে বিষ্ণুপদ মুখোপাধ্যয়-সহ অনেকেই ছুটে আসছেন। কারণ তাঁদেরই প্রচলিত পুজোর যে এ বার রজত জয়ন্তী বর্ষ। |