শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) নবগঠিত বোর্ড নিয়ে ক্ষোভ ক্রমশ বাড়ছে জলপাইগুড়িতে। কংগ্রেস শুধু নয়, সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংস্থার প্রতিনিধি, বিশিষ্ট জনেরাও ক্ষুব্ধ। বাম ও কংগ্রেস তো বটেই, এসজেডিএ-র বোর্ড গঠন নিয়ে তৃণমূলের অন্দরেও প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে!
এসএমএস থেকে ফেসবুক সর্বত্রই এখন ‘জলপাইগুড়িকে বঞ্চিত করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কারণ, শিলিগুড়ি পুরসভার ডেপুটি মেয়র রঞ্জন শীলশর্মাকে এসজেডিএ-র সদস্য করা হলেও জলপাইগুড়ি পুরসভার প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা পুর চেয়ারম্যান মোহন বসুর নাম রাখা হয়নি। এমনকী, প্রাক্তন আমলা তথা বিধায়ক সুখবিলাস বর্মাকেও ওই বোর্ডে নেওয়া হয়নি। তাই জলপাইগুড়ির বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত ভাবে নাগরিক কনভেনশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কংগ্রেসও তাতে সামিল হয়েছে।
জলপাইগুড়ির পুর চেয়ারম্যান মোহনবাবু বলেন, “মানুষের ভোটে যাঁরা জিতে আসেন, উন্নয়ন নিয়ে তাঁদের মানুষের কাছে জবাবদিহি করার দায়বদ্ধতা থাকে। যাঁরা জনপ্রতিনিধি নন, তাঁদের সেই দায়বদ্ধতা নেই। এসজেডিএ-র নতুন বোর্ডে জলপাইগুড়ির কোনও জনপ্রতিনিধি নেই। ফলে, বিভাগীয় সদর আবার বঞ্চিত হতে চলেছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। শহরবাসীকে নিয়ে কনভেনশন ডেকে জনমত যাচাই করে পৃথক উন্নয়ন পর্ষদ গড়ার দাবি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছে জানানো হবে।”
জেলা কংগ্রেস এসজেডিএতে ‘দলতন্ত্রে’র অভিযোগ তুলে কনভেনশন করে সরাসরি বিরোধিতায় নামা হবে বলে জানানো হয়েছে। শহর ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি পিনাকী সেনগুপ্ত বলেন, “প্রদেশ নেতৃত্বকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমরা কনভেনশন করে আন্দোলন শুরু করব।” এসজেডিএ-তে জলপাইগুড়ির জনপ্রতিনিধিরা না-থাকায় শহরের উন্নয়নের কী হবে, সেই আশঙ্কায় সাধারণ বাসিন্দাদের মধ্যেও প্রশ্ন উঠেছে।
বস্তুত, কী ভাবে ওই বোর্ড সদস্যদের নির্বাচন করা হল, তা নিয়ে তৃণমূলের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা নেতৃত্বের একাংশও প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, দলের কয়েক জন নেতা মর্জিমাফিক কাজ করছেন। তৃণমূলের দুই জেলার একাধিক প্রবীণ নেতা বলেন, “সিপিএম ও কংগ্রেস দলতন্ত্র বললেও তা আমরা মানতে পারছি না। কারণ দলতন্ত্র মানে হল, দলের সকলে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। রাজ্যে আমাদের সরকার গঠনের পরে কোনও কমিটি গড়ার আগে জেলা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়নি। কয়েক জন নেতার যেমন মনে হচ্ছে, তেমনই নাম ঘোষণা হয়ে যাচ্ছে!”
মঙ্গলবার সকাল থেকেই ‘জলপাইগুড়ি বঞ্চিত’ বলে নানা এসএমএস চালাচালি হচ্ছে। শহরের একটি ক্লাবের সদস্য ভাস্কর দাস বলেন, “অজস্র এসএমএস পেয়েছি। ফেসবুকেও জলপাইগুড়ি উন্নয়নে বঞ্চিত হয়েছে বলে লিখেছি। তার অসংখ্য সমর্থনও পেয়েছি। অনেক সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। কেউই বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না।” প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শহরের বিশিষ্টেরাও। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন প্রধান আনন্দগোপাল ঘোষ বলেন, “কী করে এমন হচ্ছে, বুঝতে পারছি না। কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। শহরের উন্নয়নের বিষয় যখন, তখন অন্তত পুরসভার চেয়ারম্যানকে রাখা বাস্তবসম্মত হত। সমাজের অন্যান্য ব্যক্তি যাঁরা উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন, গবেষণা করে তাঁদের রাখা যেত। উত্তরবঙ্গের এই বিভাগীয় প্রধান শহর অবহেলিতই থেকে গেল!”
সাহিত্যিক বেণু দত্তরায় বলেন, “পরিকাঠামোগত উন্নয়নের অনেকটাই বাকি জলপাইগুড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস থেকে স্পোর্টস কমপ্লেক্স সবই বকেয়া রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জনপ্রতিনিধিদের থাকা দরকার ছিল। এটাই তো গণতন্ত্রের দাবি।” আয়কর আইনজীবী তথা সমাজকর্মী মিহির বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “মিশন সিটি তৈরি করে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি দুই শহরকে কাছে এনে উন্নয়নে জোর দেওয়ার প্রয়াস যে সময়ে শুরু হয়েছে, তখন এসজেডিএ-র নতুন বোর্ডের গঠন দুই শহরের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।”
জলপাইগুড়ি জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক সাধন বসু বলেন, “বাম আমলেও যে বঞ্চনা ছিল জলপাইগুড়ির জন্য, এই সরকারের আমলেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।” নর্থ বেঙ্গল চেম্বার অব কর্মাসের সম্পাদক সমরেন্দ্রপ্রসাদ বিশ্বাসের বক্তব্য, “জলপাইগুড়ির যিনি আছেন, তিনি জনপ্রতিনিধি নন। মানুষের চাহিদার কথা তিনি জানেন না। তা হলে কি জলপাইগুড়ির কথা এসজেডিএ-তে উপেক্ষিতই থেকে যাবে?” |