প্রবন্ধ ২...
দুই দেশ, এক নদী
বন্দরের কাল হবে শেষ?
যেন ক্রিকেটের স্কোর। যশোহরের রাস্তায় ঝিনাইদহ পেরিয়ে রাস্তার ধারে একটা চায়ের দোকানে শুনলাম প্রশ্নটা। ‘আজ কত?’ গ্রামে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক। কিন্তু ঢাকার বেবি-ট্যাক্সি চালকও ১৯৯৭-এর মে মাসে যখন জানতে চান ফরাক্কা থেকে ছাড়া জলের হদিশ, সমস্যা অন্য মাত্রা পায়। বন্দর কর্তৃপক্ষ ছাড়া কলকাতায় ফরাক্কার খবর কে রাখে? তার মানে এই নয় যে গঙ্গার জল এই বাংলার সমস্যা নয়। তার মানে হয়তো এই যে দু’বাংলায় নদী দু’ভাবে জীবনে রেখাপাত করে।
ঠিক, জলের অভাবে হুগলি মজেছে। তাতে কলকাতা বন্দরকে গভীরতার খোঁজে হলদিয়ায় আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। একই সঙ্গে ও পার বাংলায় গঙ্গা-পদ্মার শাখা নদী রূপসায় বাড়ছে নুন। রাজশাহিতে আর্সেনিকের প্রকোপ বাড়ার কারণ হিসাবে পদ্মার জলের স্তর নেমে যাওয়াকেই দায়ী করা হয়। এই সমস্যার সমাধানের খোঁজই হল গঙ্গা জল চুক্তি।
১৯৬০-এ তৎকালীন পাকিস্তানের সঙ্গে জল ভাগাভাগির জন্য সিন্ধু জল চুক্তিতে সই করে দুই দেশ। তখনই ফরাক্কা থেকে নীচে গঙ্গার জল কার ভাগে কতটা আসবে তাই নিয়ে কথার প্রস্তাব ওঠে। ১৯৫১-তেই ভাগীরথীতে নাব্যতার সমস্যা দেখা দেয়। কলকাতা বন্দরের সমস্যা সেই সময় থেকেই। ফরাক্কায় বাঁধ করে ভাগীরথীর স্রোত বাড়িয়ে নাব্যতার সমস্যা মেটানোর কথা ভাবতে শুরু করে ভারত। ১৯৬০ সালে ৭,৩৬৩ ফুট দীর্ঘ ফরাক্কা বাঁধ তৈরি শুরু হয়। তৈরি হয় এমন ভাবে যাতে ২৭ লক্ষ কিউসেক পর্যন্ত জল এই বাঁধের মধ্যে দিয়ে যেতে পারে। কিন্তু স্রোত কমে গেলে ৪০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত জল বন্টন করতে পারে। অর্থাৎ জল কমলে ও পারের জন্য যদি ৩০ হাজার কিউসেক ছাড়া হয়, এ পারের জন্য ছাড়া যাবে ১০ হাজার কিউসেক।
১৯৭৪-এ বাঁধ সম্পূর্ণ হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে ফরাক্কা থেকে পরীক্ষামূলক ভাবে জল ছাড়া শুরু হয়। শুরু হয় মতান্তরও। রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত বিষয়টা গড়ায়। ১৯৭৭ সালে ভারত ও বাংলাদেশ পাঁচ বছরের জন্য জল-চুক্তিতে সই করে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ফরাক্কার গড় প্রবাহের ৭৫ শতাংশের উপর ভিত্তি করে জল ভাগ করার সময় ঠিক হয় জানুয়ারি থেকে মে মাস। এই সময়টাকে জল ভাগের জন্য ১০ দিনের ১৫টি ভাগে ভাগ করা হয়। ঠিক হয়, বাংলাদেশ ফরাক্কায় প্রবাহের ৬০ শতাংশ পাবে, এ পারের জন্য বরাদ্দ ৪০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের ন্যূনতম বরাদ্দ হবে ৩৪৫০০ কিউসেক আর ভারতে থাকবে ২০৫০০ কিউসেক। প্রবাহ যদি সাংঘাতিক কমে যায় যার ফলে এই অঙ্ক মেলানো যাবে না তখন যে প্রবাহই থাক, বাংলাদেশকে তার ৮০ শতাংশ দিতে হবে।
১৯৮২ সালে চুক্তি ফুরোয়, কিন্তু নানা বিরোধে নতুন জল চুক্তি হতে লাগে ১৪ বছর। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকার এই প্রসঙ্গ তোলে এবং নতুন করে চুক্তি সই হয় সে বছর ১২ ডিসেম্বর। এই চুক্তিতে ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গড় প্রবাহের ৫০ শতাংশ (আগের চুক্তিতে ছিল ৭৫ শতাংশ) ধরে জল ভাগের অঙ্ক করা হয়। আর এই চুক্তির সঙ্গে আগের চুক্তির ফারাক প্রবাহের অঙ্কের বাইরে গিয়েও কঠিন পরিস্থিতি আলোচনার মাধ্যমে জল ভাগের ব্যবস্থা করে। এই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ পাবে ৪৫ শতাংশ জল। মার্চ থেকে মে দু’পক্ষই চক্রাকারে ৩৫ হাজার কিউসেক জল পাবে। মূল প্রবাহ যদি ৫০ হাজার কিউসেকে নেমে যায় তা হলে ভাগীরথীতে আসবে ৩৫ হাজার কিউসেক। এর নীচে জল নামলে ভাগের অঙ্ক ঠিক করা হবে দু’পক্ষের আলোচনায়। ১৯৯৬-এর ফরাক্কা চুক্তিই যে পরে তিস্তা চুক্তির আধার হবে তা-ও উল্লেখ করা হয়। চুক্তির শর্ত
তৈরি হয় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে কথা বলেই।
সমস্যা মেটেনি। অজয় দীক্ষিতের মতো নদী-বিশেষজ্ঞের মতে সমস্যার বীজ অনেক গভীরে। আপাতদৃষ্টিতে গঙ্গার নাব্যতা বজায় রাখার প্রয়োজন প্রায় পুরোটাই কলকাতা বন্দরের জন্য। কিন্তু এতে কলকাতা বন্দরের সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি। এই চুক্তির কারণে শুখা মরসুমে কিছু দিন কলকাতা বেশি জল পাবে, অন্য দিনগুলোতে বাংলাদেশ বেশি। এতে কৃষির জন্য অসুবিধা নেই, যদি ধরে নেওয়া হয় প্রবাহ যথেষ্ট ভাল। কিন্তু বন্দরের প্রয়োজন গোটা বছর ধরে জাহাজ চলাচলের উপযোগী নাব্যতা। কখনও জল বেশি, কখনও কম, বন্দরের কাজ এতে চলে না। তার উপরে স্রোত কমায় পলির সমস্যা বেড়েছে বই কমেনি।
পলি যেমন বন্দরকে খায়, খায় কৃষিকেও। প্রবাহ কমলে নদী মজে। বালি বাড়ে। মরুকরণের সূচনা হয়। মূল নদীতে জল কমলে শুকোয় শাখা নদীরাও। জলে নুন বাড়তে শুরু করে। ফলে মার খেতে থাকে চাষ। নুন মাপার একক হল মাইক্রোমোহ্স। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি রূপসার জলে ২৬ বছর আগেও নুনের পরিমাণ ছিল ৩ মাইক্রোমহ্স আর ৯৭-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার। সমুদ্রের জল উজানে ঠেলছে নুন। ক্ষীণতোয়ার সেই শক্তি নেই যে তা ঠেলে সমুদ্রে ফেরত পাঠায়। তবে নুনের পরিমাণ ২ ছাড়ালেই তা আর চাষের উপযোগী থাকে না। অর্থাৎ ১৯৭০ থেকেই সমস্যার শুরু। অজয় দীক্ষিতের মতো বিশেষজ্ঞদের দাবি, অববাহিকার সমস্যা মেটাতে উজানে উঠতে হবে। বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশ গঙ্গার বিভিন্ন উপনদী থেকে জল তুলে নেওয়ায় গঙ্গার জলের সূত্রই বিপন্ন। গঙ্গা জল তৈরি করে না, উজান থেকে জল বয়ে আনে মোহনায়। ভারত সরকারও মেনে নিয়েছে উজানের চাপে কী ভাবে মোহনা শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর কোনও সমাধান করে উঠতে পারেনি। ফলে মোহনা অঞ্চলে মরুকরণের মতো যে সমস্যা তৈরি হয়েছে দুই বাংলায়, তার সমাধান রাজনৈতিক পথেই খুঁজতে হবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.