পূজা আসিতেছে। অব্যবস্থাও। তবে, কলিকাতা পুরসভা জানাইয়াছে, এই দফায় তাহাদের লক্ষ্য ‘পরিষেবা ও নিয়ন্ত্রণ’। অর্থাৎ, যে পূজার জন্য যতখানি জায়গা বরাদ্দ হইয়াছে, তাহা ছাপাইয়া পূজার প্যান্ডেল বা দোকানপাট রাস্তায় নামিয়া আসিতেছে কি না, পুরসভা তাহা বিশদে দেখিবে বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছে। শহরের শৃঙ্খলা এবং নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য যাহাতে বজায় থাকে, তাহাও নাকি নিশ্চিত করা হইবে। হইলে ভাল। পূজার কয়েকটি দিন শহরবাসীর নিকট বাৎসরিক নরকবাসের সময়। রাস্তায় বাস দাঁড়াইয়া থাকে, ফুটপাথে মানুষের দাঁড়াইবার জায়গাটুকুও থাকে না। শহরের বহু বারোয়ারি পূজা নিয়মিত ভাবে স্থানীয় বাসিন্দাদের চরম অসুবিধার কারণ হয়। কাহারও সদর দরজা হইতে বাহির হইবার উপায় থাকে না, কাহারও বাড়ির দেওয়াল পূজা কমিটির নির্দিষ্ট শৌচাগারে পরিণত হয়। তাহার উপর লাউডস্পিকারের দৌরাত্ম্য তো থাকেই। রাতের তৃতীয় প্রহরে ভুল বাংলায় আগত দর্শনার্থীদের উদ্দেশে স্বাগত ভাষণ শুনিবার জ্বালা কী, ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। এই শহরব্যাপী অব্যবস্থার মধ্যে যদি কেহ অসুস্থ হইয়া পড়েন, যদি কোথাও অগ্নিকাণ্ড ঘটে, তাহার পরিণতি কী, ভাবিলে আতঙ্কিত হইতে হয়। পুরসভা যদি সত্যই পূজার শহরে নিয়ন্ত্রণ আনিতে পারে, যদি নাগরিক জীবনের ন্যূনতম পরিষেবার অধিকার নিশ্চিত করিতে পারে, তবে শহরবাসী নিশ্চয়ই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইবে। কিন্তু, শুধু সদিচ্ছা থাকিলেই সেই উদ্যোগ সফল হইবে না, তাহার জন্য নিশ্ছিদ্র পরিকল্পনা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট সকল দফতর, প্রতিষ্ঠানকে এই প্রকল্পে শামিল করিতে হইবে। পুরসভার বৈঠকে পুলিশ, দমকল, বিদ্যুৎসংস্থা ইত্যাদির কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। লক্ষণটি শুভ। তাহা ফলপ্রসূ হইলেই মঙ্গল। একটি প্রশ্ন অবশ্য থাকিয়াই যায়। শহরের পথে-ঘাটে, পার্কে, মাঠে এত পূজা হইবে কেন? গাড়িঘোড়ার যেমন পথের উপর অধিকার আছে, শিশু-বৃদ্ধ-বায়ুসেবনকারীদের তেমনই পার্কের উপর, মাঠের উপর অধিকার আছে। পূজার অজুহাতে তাঁহাদের সেই অধিকার হইতে বঞ্চিত করা কেন? প্রথম কথা, বারোয়ারি পূজার অ্যামিবার ন্যায় বংশবৃদ্ধি রোধ করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, রাস্তা রোধ করিয়া তো নহেই, মাঠ দখল করিয়াও পূজা করিতে দেওয়া উচিত নহে। বারোয়ারি পূজা যদি করিতেই হয়, তাহার জন্য হলঘর ভাড়া করা হউক। প্রস্তাবটি যাঁহাদের নিকট অলীক ঠেকিবে, তাঁহারা বিবাহানুষ্ঠানের কথা ভাবিয়া দেখিতে পারেন। কয়েক দশক পূর্বেও বিবাহ উপলক্ষে ম্যারাপ বাঁধাই নিয়ম ছিল। এখন শহরাঞ্চলে ম্যারাপ বাঁধা বিবাহের সংখ্যা অঙ্গুলিমেয়-ও নহে। হল ভাড়া করিয়া অনুষ্ঠান হয়, এবং তাহাই দস্তুর। পূজার ক্ষেত্রেই বা তাহা হইবে না কেন? বস্তুত, প্রবাসী বাঙালিরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যে পূজা করিয়া থাকেন, তাহা এই ভাবেই হয়। যে কোনও সভ্য শহরে এই ব্যবস্থাই বিধেয়। শহর কলিকাতার চেতনা জুড়িয়া এখনও গ্রাম বিরাজ করে। তিন শতাধিক বৎসরেও জোব চার্নকের এই নগর প্রকৃত শহরে পরিণত হয় নাই। সেই কারণেই পথ আটকাইয়া বারোয়ারি পূজা করিতে এই শহরের এত উৎসাহ। কিন্তু, অন্তরের সেই গ্রামটিকে প্রশ্রয় দিলে কলিকাতার আর বয়ঃপ্রাপ্তি হইবে না। রাজ্য জুড়িয়া এখন পরিবর্তনের সুবাতাস বহিতেছে। সেই হাওয়ায় কলিকাতার এই দীর্ঘলালিত কু-অভ্যাসটিও এই বার বদলাক। বৎসরের ৩৬৫ দিন (আগামী বৎসর ৩৬৬ দিন) শহর নাগরিকদের জন্য থাকুক। উৎসব নিজের জায়গায় থাকুক। শহরের শ্বাসরোধ না করিয়াই শারদোৎসবের আয়োজন হউক। |