মহম্মদ আজহারউদ্দিনের ছেলে, তরুণ ক্রিকেটার আয়াজউদ্দিন কিংবা কলকাতার সেন্ট টমাস স্কুলের সুপ্রিয় রায়। মাত্র এক মাসের মধ্যে দুই শহরে দুই দুর্ঘটনা। মোটরবাইকের পিছনের আসন থেকে ছিটকে সুপ্রিয় মারা যায় রাস্তাতেই, আয়াজ হায়দরাবাদের হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। দু’জনের কারও বয়সই কুড়ি পেরোয়নি।
পিসতুতো ভাই আজমলকে নিয়ে হায়দরাবাদের রিং রোডে স্পোর্টস-বাইক ছোটাচ্ছিলেন আয়াজ। সুপ্রিয় সে ভাবে ‘রেস’ দিচ্ছিল না। তার সহপাঠী আতিফ বাইক চালাচ্ছিল, সে ছিল পিছনে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, যে গতিতে বাইকটি ছুটছিল, তাতে বোঝা যায়, চালক মনে মনে একটি বাজি ধরেছিল। দ্যাখ, মাত্র দু’মিনিটে এই ফ্লাইওভারটা পেরিয়ে যাব! এ ভাবেই গতির কায়দাবাজি চলে। |
আর সেই কায়দাবাজি বোঝা যায় রাত দশটার পরে। নিউ আলিপুর থেকে মৌলালি, সল্টলেক শহরের যে কোনও রাস্তায় দাঁড়ালেই তখন চোখে পড়বে দৃশ্যটা। বাইকে চেপে দু’তিন জন ছেলে তীব্র গতিতে সাঁৎ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার লোক হতভম্ব, কারও বা অস্ফুট চিৎকার। কিন্তু শব্দ মুখ ফুটে বেরোনোর আগেই তারা ধাঁ!
এই কায়দাবাজিটা গাড়িতে হয় না। কিন্তু বাইক মানেই উদ্দাম তারুণ্যের বাঁধনছেঁড়া গতি। দু’হাতে হ্যান্ডেল ধরে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ছুটে যাওয়া, হাতের পেশি টানটান। সিনেমার পর্দায় জন আব্রাহাম এ ভাবেই বাইক চালাতে চালাতে ‘ধুম মচিয়ে’ দেন না? ধোনি কি এ ভাবেই তাঁর ‘হার্লে ডেভিডসন’ বাইকে সওয়ার হয়ে ছুটে যান না?
গতিময় তারুণ্য এবং বাইক এ ভাবেই আজ প্রায় সমার্থক। “বাইকের বিজ্ঞাপনগুলি দেখবেন। তারুণ্যই সেখানে ব্র্যান্ড-ইকুইটি। কেউ বলবে, এটা এমন বাইক, কলেজে এলে মেয়েরা তাকাবেই। কেউ আবার বলবে, বান্ধবীকে নিয়ে বেড়াতে যাবে? ইট্স কুল, ইয়ার,” বলছিলেন বিপণন-বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায়।
এই ‘কুল’ ব্যাপারটা সমাজের সর্বস্তরের তরুণরাই নিয়ে ফেলেছে। রাতবিরেতে এই খেলাটাই তাদের নেশা। ভয় লাগে না? তাড়া করে না মৃত্যুর আতঙ্ক? এক বাইকার জানাল, ‘নো টেনশন বস্! টেনশন দেনেকে লিয়ে, লেনে কা নহি।’ বয়স বড়জোর ২২ কি ২৩। ‘মুন্নাভাই’টি ক্লাস এইট অবধি পড়াশোনা করে এখন পাড়ায় রড, সিমেন্ট সাপ্লাইয়ের কাজ করে। তার মধ্যেই কিনে ফেলেছে সেকেন্ড হ্যান্ড বাইক। |
কলকাতা থেকে হায়দরাবাদ, কেন সর্বত্র মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এ ভাবে বাইক ছোটায় তারুণ্য? মনোবিশ্লেষক সুধীর কক্কর বলেন, “আসলে ১৮ থেকে ২৪ বছর অবধি বয়সটাই এমন, মৃত্যু অবচেতনেও হানা দেয় না। মানে, আমি যে মরে যেতে পারি, এই আশঙ্কা ওই বয়সী একটি ছেলে বা মেয়ের মাথাতেই আসে না।”
আর, মৃত্যুহীনতার এই সম্ভাবনা থেকেই কলকাতা শহরেও তৈরি হয়ে গিয়েছে ‘ডেভিল্স ডিসাইপল্স’, ‘রাগবি রাইডার্স’, ‘ওয়াইল্ড হক্স’, ‘হেলরাইডার্স’ গোছের অজস্র ক্লাব। এই সব ক্লাবের কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানা বা ঘরবাড়ি নেই। দিনের বেলায় কাউকে খুঁজে পাবেন না। কিন্তু রাত দশটার পরে কালিকাপুর বা খিদিরপুর ফ্লাইওভারের আগে জড়ো হবে পাঁচ-সাতটি বাইক। ‘মুন্নাভাই’রা তার পরে তীব্র গতিতে ছুটে যাবে, ফিরেও আসবে। ‘দাদাগিরি’ এতটাই যে, খিদিরপুর ফ্লাইওভারে ওঠার আগে ‘ডেভিল্স ডিসাইপল্স’ লিখে রেখেছে, ‘উই মেস দ্য রোড’।
আর অন্য দিকের উঁচুতলা? ‘ইস্টার্ন বুলস’ ক্লাব-সদস্যেরা প্রায়শ বাইকে চেপে বেরিয়ে পড়েন গ্যাংটক বা লাদাখের দিকে, অ্যাডভেঞ্চারে। ইন্টারনেটেও তাঁদের ক্লাবের ঠিকানা আছে। ক্লাবের তরফে অরিজিৎ ভট্টাচার্য জানালেন, তাঁদের বাইক-অ্যাডভেঞ্চারে ১৯ থেকে ৫৬ বছর বয়সীরা থাকেন। হেলমেট থেকে ‘নি গার্ড’, ‘অ্যাঙ্কল গার্ড’ সবই জরুরি।
সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, এখানেই বাইক একটি নতুন সামাজিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়। উঁচু তলা আর নিচু তলার ফারাক থাকে না। কারণ, তরুণ বাইকাররা সব সময়েই ‘সাব কালচার’ বা ‘তলার সংস্কৃতি’র প্রতিভূ। এই সাব-কালচারে কোনও শ্রেণিবিভাজন থাকে না। কোটিপতির ছেলে আর গরিবের ছেলে একই রক গ্রুপে থাকতে পারে, একই সঙ্গে গাঁজা টেনে ‘পাঙ্ক’ বনে যেতে পারে। তারুণ্য, পাঙ্ক, বাইকার, রক গ্রুপ সংস্কৃতির পরিভাষায় এরাই ‘সাব কালচার’। আর সেই সাব-কালচার মূল সংস্কৃতির একাধিপত্যকে প্রশ্ন করে। বড়দের সংস্কৃতি ৪০ কিমি/ঘণ্টায় বাইক চালানোর ফতোয়া দিতেই পারে, তারুণ্য সব সময়ে সে কথা মানবে কেন?
দুর্ঘটনা নানা কারণেই ঘটতে পারে। কিন্তু মাত্র এক মাসের ব্যবধানে কলকাতা আর হায়দরাবাদ একটি সত্য জানিয়ে দিয়েছে। আধুনিক সমাজে বেপরোয়া তারুণ্য এবং বাইকের মানসিক বন্ধন। কলকাতার ‘সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস’-এর কালচারাল স্টাডিজের শিক্ষক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন এ শহরের ‘হেলরাইডার্স’ বা ‘ডেভিল্স ডিসাইপল্স’ গোছের ক্লাবগুলির নাম এককথায় ব্যাখ্যা করে দিলেন, “এর মানে শয়তানের চেলাচামুন্ডা বা বাজে কিছু নয়। তারুণ্যের প্রতিস্পর্ধা।”
সমাজতাত্ত্বিক প্রদীপ বসু আবার জানালেন, এই তারুণ্য সব সময়েই নাগরিক তারুণ্য! “শহরেই সাব-কালচারের প্রাধান্য, তাই এদের অন্য নাম আরবান ট্রাইব।”
অবশ্যই! কলকাতার সুপ্রিয় আর হায়দরাবাদের আয়াজরা প্রতি মুহূর্তে জীবনকে বাজি রেখে প্রমাণ করে যাচ্ছে, তারা একই মানসিকতার, একই গোষ্ঠীর সদস্য। |