মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় সুশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রাথমিক দায়িত্ব যে রাজ্য সরকারেরই, তা ফের মনে করিয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। আর সেটা করতে গিয়ে মাওবাদী দমনে আরও আধা সামরিক বাহিনীর জন্য জেলাশাসকদের আর্জিকে প্রায় গুরুত্বই দিলেন না তিনি। বরং তাঁর পরামর্শ, রাজ্যের রাজধানীতে বসে নীতি নির্ধারণ না করে মুখ্যমন্ত্রীদের উচিত মাওবাদী এলাকায় গিয়ে অন্তত একটা রাত কাটানো। মানুষের মন জয় করা।
মাওবাদী অধ্যুষিত ৬০টি জেলার জেলাশাসকদের সঙ্গে এ দিনের বৈঠকে চিদম্বরমের মন্তব্য ঘিরে বিতর্ক দানা বেঁধেছে। অবশ্য এমনটা নতুন নয়। অতীতেও আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে রাজ্য সরকারগুলিকে ‘দায়িত্ব’ মনে করিয়ে বিবাদে জড়িয়েছেন চিদম্বরম। ২০১০ সালের এপ্রিলে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ে এসে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বিঁধতে গিয়ে ‘দ্য বাক স্টপস উইথ ইউ’ মন্তব্য করে তুমুল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন চিদম্বরম। এর ক’দিন পরেই ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী হানায় ৭৬ জন সিআরপি জওয়ানের মৃত্যুকে ঘিরে ফের রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিবাদে জড়ান তিনি। ওই ঘটনার দায় পরোক্ষে রাজ্য সরকারের ঘাড়ে ঠেলায় চিদম্বরমের কড়া সমালোচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ। সম্প্রতি দিল্লি বিস্ফোরণ নিয়েও তাঁর মন্তব্য ঘিরে কথা উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
স্বাভাবিক ভাবেই চিদম্বরমের আজকের মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে বিজেপি। দলের বক্তব্য, এ ধরনের কথা বলে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দলের মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকর রীতিমতো কটাক্ষ করে বলেন, “যত ক্ষণ চিদম্বরম আছেন, তত ক্ষণ প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ শুনবো আমরা!” মাওবাদী দমনের বিষয়টি কোনও একটি রাজ্যের দায় নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। চিদম্বরমের বক্তব্য নিয়ে অবশ্য সবিস্তার কিছু বলতে চাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আইনশৃঙ্খলা প্রশ্নে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে তিনি বলেন, “যদিও আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়, তবু মাওবাদী দমনে কেন্দ্র-রাজ্য হাত মিলিয়েই কাজ করা দরকার।” |
আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই সুরই আজ শোনা গিয়েছে মাওবাদী অধ্যুষিত জেলাগুলির জেলাশাসকদের নিয়ে দিল্লিতে এক কর্মশালায়। মাওবাদী এলাকায় উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে কেন্দ্র যাতে আরও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে, সেই দাবিও এ দিন ওঠে। কিন্তু চিদম্বরম এই আবেদনকে বিশেষ গুরুত্বই দিতে চাননি। জেলাশাসকদের বক্তব্য শোনার পরে তিনি বলেন, “আপনাদের বক্তব্যের অর্থ হল, মাওবাদী এলাকায় সুশাসন ও আইনশৃঙ্খলা কায়েম রাখার দায়িত্ব রাজ্যের পরিবর্তে কেন্দ্রের ওপর চাপানো উচিত! কিন্তু তা হয় না। এ ব্যাপারে প্রাথমিক দায়িত্ব রাজ্যের। কেন্দ্র কেবল সহযোগীর ভূমিকা নিতে পারে।” তাঁর বক্তব্য, মাওবাদী এলাকায় ইতিমধ্যে আধা সামরিক বাহিনীর ৭১ ব্যাটেলিয়ন তথা ৪৫ হাজার জওয়ান মোতায়েন রয়েছে। এই তথ্য তুলেই তাঁর প্রশ্ন, “আরও ৪৫ হাজার জওয়ান মোতায়েন করলেই কি সমস্যা মিটে যাবে?” মাওবাদী সমস্যা মোকাবিলা সন্ত্রাসবাদ দমনের থেকেও বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করে চিদম্বরম বলেন, “আসল ঘাটতি রয়েছে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে প্রশাসনের আস্থার সম্পর্কের। তাঁদের মন জয় করতে হবে। না হলে তাঁরা মাওবাদীদেরই বন্ধু বলে মনে করবেন।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ জানান, মাওবাদী অধ্যুষিত ৬০টি জেলায় আর্থ সামাজিক পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে ‘ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকশন প্ল্যান’ তৈরি হয়েছে। ওই যোজনার আওতায় আরও ১৮টি জেলাকে এনে বছরে ৩০ কোটি টাকা অতিরিক্ত অর্থবরাদ্দ করা হবে। পরে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ জানান, প্রস্তাবিত ওই ১৮টি জেলার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়াও রয়েছে। বর্তমানে কেবল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা রয়েছে ওই যোজনার আওতায়।
এ দিনের কর্মশালায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-ও মাওবাদী এলাকার মানুষের মন জয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “ছত্তীসগঢ়ের নারায়ণপুরে প্রশাসন যে কাজ করতে পারেনি, তা রামকৃষ্ণ মিশন করে দেখিয়েছে। মিশনের স্বামীজিরা স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তাঁদের পরিষেবা দিচ্ছেন। ফলে সরকারেরও এখন লক্ষ্য হল, মাওবাদী তথা আদিবাসী এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করা। উন্নয়নে স্থানীয় মানুষকে সামিল করাই হল নতুন স্লোগান।” সেই সঙ্গে উন্নয়ন কর্মসূচি রূপায়ণে বিন্দুমাত্র অসততা বরদাস্ত করা হবে না বলেও এ দিন জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি জানান, এই সব কাজে যাতে দুর্নীতি না হয়, তা সুনিশ্চিত করাই হবে আমলাদের কাজ। |