সকাল থেকেই তিথির মনটা বেশ ফুরফুরে। শাঁওলি আসছে।
কলেজের পাট চুকে যাওয়ার পরে চাকরি নিয়ে ভিন্রাজ্যে শাঁওলি। তিথি এখনও কলকাতাতেই। কাজের চাপে যোগাযোগ অনেক কমে গিয়েছে। কাল রাতে অনলাইন হতে না হতেই স্ক্রিনে শাঁওলির মেসেজ, ‘পুজোয় আসছি। চার দিনের প্ল্যান করে রাখিস কিন্তু।’
বেশ কিছু পুজোর লিস্ট তখনই শাঁওলিকে জানিয়ে রেখেছিল তিথি। ‘কুমোরটুলি সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ দেখতেই হবে। ওদের থিম পঞ্চভূত। প্লাস্টার অফ প্যারিস ও ফাইবার গ্লাসের তৈরি মণ্ডপের মাথায় চলবে কৃত্রিম বৃষ্টি। তার পিছনেই সূর্য। মণ্ডপের ভিতরে থাকবে ঝর্না, জলাশয়ও। আর সাধারণ পোশাকে মানবীরূপী প্রতিমাকে শূন্যে এমন ভাবে রাখা হবে, মনে হবে যেন আকাশ থেকে নেমে আসছেন। ‘কাশী বসু লেন দুর্গাপূজা কমিটি’ও ছাড়লে চলবে না। বাঁশ, স্পঞ্জে গড়া পাহাড়ে দক্ষিণ ভারতীয় আদলের তৈরি হচ্ছে মন্দির। মাটির প্রতিমার রং দেখে নাকি মনে হবে রুপোর সিংহাসনে বসে আছে সোনার প্রতিমা। দেখতে হবে ‘রূপচাঁদ মুখার্জি লেন সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ও। ত্রিভুজাকৃতি মণ্ডপে দু’পাশের দেওয়াল জুড়ে চারশোরও বেশি দেবদেবীর ছবি। মূল মণ্ডপে সাজসজ্জা, আলো ও শব্দের খেলায় দেখা যাবে বিভিন্ন দেবদেবীর থেকে শক্তি নিয়ে দেবী দুর্গার অসুর নিধন।
নিজের জানা পুজোগুলোর কথা বলেই ঘুমোতে গিয়েছিল তিথি। শাঁওলিকে বলে রেখেছিল, ‘আরও খবর পেলেই জানাব।’ সকালে অফিস পৌঁছেও দেখে কাজে একটুও মন নেই। এক ফাঁকে পাশের কিউবিকলে বসা অমৃতাকে কারণটা বলতেই ও লাফিয়ে উঠল। বলল, ওদের এলাকার ‘সেলিমপুর নস্করপাড়া’র পুজোটা অবশ্যই দেখতে। মণ্ডপের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বায়ুলোক, অগ্নিলোক ও বারিলোক। ব্যবহার করা হয়েছে গরুর গাড়ি ও হাতে টানা রিক্শার অসংখ্য চাকা। মণ্ডপে হাওয়ার মধ্য দিয়ে বায়ুলোক পার হয়ে যেতে হবে অগ্নিলোকে। সেখানে থাকবে কৃত্রিম আগুনের শিখা। চার দিক সাদা ধোঁয়ায় ভরা। তা পেরিয়ে বারি মণ্ডল। জলের ধারার মধ্যে দিয়েই দেখা যাবে ওপারে তৈরি আদ্যালোকে সাবেক প্রতিমাকে। পুরো ব্যপারটা হল আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলের মধ্যে বিজ্ঞানকে নিয়ে আসা।
পুজো নিয়ে আলোচনা কানে যেতেই আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছিল সৈকত আর সুনন্দা। চা খেতে যাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে হইহই করে উঠল ওরা। গাঙ্গুলিবাগানে সৈকতদের বাড়ির কাছে ‘বেলতলা সর্বজনীন’-এর মণ্ডপ হচ্ছে শামুকের আকারের। নানা রং ব্যবহার হলেও মূলত মণ্ডপ হবে সাদা রঙের উপরই। প্রতিমা সাবেক। তবে তার রং হবে মণ্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। শামুককে সুরক্ষিত করাই এ বারের পুজোর থিম। মণ্ডপের বাইরে মাঠে বিভিন্ন রকম শামুকের ছবি দিয়ে নানা বিবরণ থাকবে। ছোটদেরও এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে থাকছে শামুকের নানা কার্টুনও। আর সুনন্দা বলল ওদের পাড়ার ‘কালীঘাট শ্রী সঙ্ঘের’ কথা। কৃষ্ণনগর ও বর্ধমানে বিখ্যাত রঙিন ‘মা’ পুতুল দিয়ে তৈরি হচ্ছে মণ্ডপ। প্রতিমাও গড়া হচ্ছে ওই পুতুলের আকারেই।
অফিসে ফোন, চ্যাট সব বারণ। কিন্তু এতগুলো দারুণ থিম জানার উত্তেজনা চাপতে না পেরে শেষমেশ শাঁওলিকে এসএমএস-ই করে বসল তিথি। আধ মিনিটের মধ্যে উত্তর। ‘অসাধারণ!’ তবে শাঁওলিও যে হাত গুটিয়ে বসে নেই, তার প্রমাণ মিলল ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে। অফিস থেকে বেরোতে না বেরোতেই ফোন। ধরতেই প্রায় চিৎকার, “কেয়াতলা পল্লি সমিতি এ বার কী করছে জানিস? কাত্যায়ন মুনির আশ্রমে দুর্গার তিন রূপ। আঠেরো হাতের মহালক্ষ্মী মহিষমর্দিনী, আট হাতের মহাসরস্বতী এবং দশ-মাথা-দশ-পা-দশ হাতের মহাকালী। থাকবে ব্রহ্মা, শিব, পার্বতী এবং লক্ষ্মীর মূর্তিও।”
শাঁওলি আরও যে ক’টা পুজোর লিস্ট ধরাল, তা এ রকম: হরিদেবপুরের ‘বিবেকানন্দ স্পোর্টিং’। থাকবে দুর্গার দুই মূর্তি। রক্ষাময়ী ও মমতাময়ী। মণ্ডপের বাইরে জাঁকিয়ে বসে সিংহ। প্রথমে চোখে পড়বে ধরিত্রী মায়ের নানা রূপ। তার পরেই শিবমন্দির। আর সব পেরিয়ে এক দিকে দশভুজা দুর্গা, অন্য দিকে একেবারে মায়ের রূপে দুর্গা। ‘হরিদেবপুর নবীন সাথী ক্লাব’। থিম: ‘মা হওয়া কি মুখের কথা’। অনেকক্ষেত্রেই মাতৃদুগ্ধ পান না করানোয় শিশুর দেহে তৈরি হচ্ছে না প্রতিরোধ ক্ষমতা। মেডিক্যাল সায়েন্সের এই সমস্যাকেই তুলে ধরছে এই পুজো। দুর্গা এখানে গণেশজননী। গণেশ মাতৃদুগ্ধ পান করছে, কোলে বসে কার্তিকও। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতেই এই থিম।
বেহালায় ‘প্রগতি সঙ্ঘ সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’। মণ্ডপের শুরুতেই রাবণের মূর্তি, অশুভের প্রতীক। তার পিছনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের মূর্তি, যাদের মিলিত শক্তিতেই দুর্গার সৃষ্টি। ফেলে দেওয়া ছিট কাপড়ে তৈরি মণ্ডপের একেবারে শেষে দুর্গা প্রতিমা।
ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তিথি দেখল তখন রাত ৮টা। ঘণ্টাখানেক লাগবে বাড়ি ফিরতে। গিয়েই চ্যাটে বসতে হবে শাঁওলির সঙ্গে। বাসের ভিড়, ক্লান্তি? দূর! ক’দিন বাদেই পুজো, এখন ও সব ভাবলে চলে?
পুজোর ঘণ্টা বাজলে বোধ হয় এমনটাই হয়! |