উত্তরবঙ্গের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একযোগে ৮৪টি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করল রাজ্য সরকার।
ওই সব প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে খরচ হবে প্রায় সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ ও নানা দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে প্রকল্পগুলি রূপায়ণ করবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর। ইতিমধ্যেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদকে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য। বাকি টাকা কেন্দ্র ও রাজ্যের নানা প্রকল্পের মাধ্যমে জোগাড় করার রূপরেখা তৈরি করেছে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর। সোমবার মহাকরণে নবগঠিত উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের প্রথম বৈঠকের পরে এ কথা জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব।
উত্তরবঙ্গের ছ’টি জেলার মধ্যে ‘পিছিয়ে পড়া’ চারটি জেলার (দুই দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি ও মালদহ) উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এমনিতেই টাকা দেয়। গৌতমবাবু জানান, এ বার রাজ্য সরকারও ওই খাতে যে টাকা দেবে, তা-ও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতরই খরচ করবে। শুধু তা-ই নয়, আগামী দিনে পর্ষদের প্রতিনিধিরা উত্তরবঙ্গের প্রতিটি জেলায় গিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের কতটা অগ্রগতি হচ্ছে এবং আরও কী কী করা দরকার তা নিয়ে স্থানীয় বিশিষ্টজনদের সঙ্গে যাতে নিয়মিত আলোচনা করেন, সেই নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিন মাস অন্তর মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে যাবেন। শিলিগুড়িতে মুখ্যমন্ত্রীর যে সচিবালয় হচ্ছে, সেখানে তিনি উন্নয়ন পর্ষদের কাজকর্ম পর্যালোচনা করবেন।
বস্তুত, উত্তরবঙ্গের কথা যে তিনি বিশেষ ভাবে ভাবছেন, তা রাজ্যে সরকার গঠনের পর থেকেই নানা পদক্ষেপ করে বোঝানোর চেষ্টা করছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর নির্দেশেই উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য আলাদা দফতর তৈরি হয়। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদকে ওই দফতরের আওতায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও তিনি দেন। পাশাপাশি, উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ করা কিংবা ব্যয়-বরাদ্দের আগে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করার ব্যাপারেও সব মন্ত্রীকে নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। গত সপ্তাহে জলপাইগুড়িতে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের অফিসে প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী (পদাধিকার বলে পর্ষদের চেয়ারপার্সন) জানিয়ে দেন, উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন বিষয়ক প্রথম বৈঠকে তিনি নিজে উপস্থিত থাকতে চান। সেই মতো এ দিন কলকাতায় বৈঠক হয়।
বৈঠকে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী বিভিন্ন জেলায় ঘুরে যে সব প্রকল্প তৈরি করেছেন, তার রিপোর্ট পেশ করে বিষয়গুলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করেন। ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে ৮৪টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। তাদের অন্যতম--সমতলের পাঁচ জেলার সদর হাসপাতাল ও আলিপুরদুয়ার হাসপাতালের আধুনিকীকরণের জন্য ৫০ কোটি টাকা জরুরি ভিত্তিতে খরচ করা হবে। জলপাইগুড়িতে হাইকোর্টের সার্কিট বেঞ্চ যাতে দ্রুত চালু হয়, সেই ভবন নির্মাণের জন্য ৫ কোটি বরাদ্দ হয়েছে। রাস্তাঘাট, সেতু তৈরি বাবদ প্রায় ৮০ কোটি টাকা খরচ করা হবে। অর্থ বরাদ্দ হয়েছে বালুরঘাটের নাট্য অ্যাকাডেমি, জলপাইগুড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জন্য। দার্জিলিংয়ে ১০০ বছরের পুরনো একটি হিন্দি-মাধ্যম স্কুলে অডিটোরিয়াম গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সেই সঙ্গে কোচবিহারে একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার ব্যাপারে উচ্চশিক্ষা দফতরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে বলে গৌতমবাবু জানান। এ ছাড়া, কোচবিহারে আব্বাসউদ্দিনের বাড়ি সংস্কার, রাজবংশী-মনীষী পঞ্চানন বর্মনের স্মৃতি সংরক্ষণ, মাদ্রাসা কলেজ গড়ার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গে রাজবংশী অ্যাকাডেমি, দার্জিলিংয়ে নেপালি অ্যাকাডেমি গড়ার প্রকল্পও রয়েছে। মংপুতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি-বিজড়িত বাড়ি সংস্কার করে সংগ্রহশালা করার জন্য ইতিমধ্যেই সাড়ে ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। ডুয়ার্সে অসম রোডে রেললাইনের উপরে একটি ফ্লাইওভার তৈরির জন্যও অর্থ বরাদ্দ হয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী জানান, কোচবিহারের রাজা সেখানে যে রাস্তা তৈরি করেছিলেন, সেটিকে ‘হেরিটেজ জোন’ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। তা ছাড়া, উত্তরবঙ্গের ‘রোড ম্যাপিং’ করে তথ্য-ভাণ্ডার গড়া হচ্ছে। সে ব্যাপারে পূর্ত দফতরের সঙ্গে কথা বলা হবে।
এত প্রকল্প এক সঙ্গে কী ভাবে হবে? গৌতমবাবুর জবাব, “পুজোর আগেই সব প্রকল্পের জন্য দরপত্র ডাকা হবে। পর্যায়ক্রমে তা বিলি হবে। সব কাজ তো এক সঙ্গে হবে না। তা ছাড়া, উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের পরিকাঠামো রয়েছে। আমাদেরও পরিকাঠামো প্রায় তৈরি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে, সব দফতরের সঙ্গে সমন্বয় করেই উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। কাজেই প্রকল্প রূপায়ণে সমস্যা হবে না।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদ গত ১০ বছরে ৩৭০ কোটি টাকা খরচ করেছে। তার মধ্যে ৪৮ কোটি টাকার ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ (ইউসি) পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন মন্ত্রী। সে জন্য বিশেষ ‘অডিট’ করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। কার গাফিলতিতে ‘ইউসি’ পাওয়া যাচ্ছে না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। এ ব্যাপারে পূর্ত দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গেও কথা বলা হবে বলে জানান গৌতমবাবু। তাঁর বক্তব্য, “আগের সরকারের আমলে প্রচুর প্রকল্প গৃহীত হয়। অনেক কাজ হয়েছে, অনেক কাজ হয়নি। সব কাজেরই মূল্যায়ন করা হবে।”
|