মনমোহন সিংহের ভাগ্য অধুনা বিশেষ ভাবে বিরূপ। যে দিকে চাহেন, সাগর শুকাইয়া যায়। তাঁহার যন্ত্রণার তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধের জন্য প্রস্তাবিত বিল। শনিবার জাতীয় সংহতি পরিষদের সভায় এই আইন-প্রস্তাবটি লইয়া সমস্ত অ-কংগ্রেসি সরকার শাসিত রাজ্যগুলির প্রবল প্রতিবাদ অনিবার্য ভাবে আশির দশকের কথা মনে পড়াইয়া দেয়, যখন কংগ্রেসি কেন্দ্রের প্রতিস্পর্ধী ‘কনক্লেভ’-এর ছত্রতলে সমবেত হইয়াছিল বিভিন্ন অ-কংগ্রেসি রাজ্য। শতাব্দী বদলাইয়াছে, কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের মূল বাস্তব বদলায় নাই। সে দিনও ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রীয়তা কেন্দ্রের দাপটে বিপন্ন হইত, আজও হইতেছে। আলোচ্য বিলটির অন্যতম প্রস্তাব, কোনও রাজ্যে বড় রকমের সংগঠিত হিংসার ঘটনা ঘটিলে তাহাকে দেশের ‘অভ্যন্তরীণ বিপদ’ হিসাবে বিবেচনা করিয়া প্রয়োজনে সংবিধানের ৩৫৫ ধারা জারি করা যাইবে। ইহার অর্থ, সেই রাজ্যের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় সরকার আপন হাতে তুলিয়া লইবে। বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এই প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানাইয়াছে। অত্যন্ত সঙ্গত আপত্তি। রাজ্যের প্রশাসন রাজ্যের দায়িত্ব। অনেক রাজ্যেই অনেক সময় সেই দায়িত্ব যথাযথ তৎপরতা এবং নিরপেক্ষতার সহিত পালিত হয় না। কখনও কখনও প্রশাসন কুশাসনে পর্যবসিত হয় এবং তাহার ফলে বড় বিপদের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তাহার মোকাবিলা করিতে গিয়া কেন্দ্র যদি রাজ্যের অধিকার কাড়িয়া লয়, তাহা কেবল অন্যায় নয়, বিপজ্জনক। রাজ্য সরকার আপন দায়িত্ব পালনে অপারগ হইলে রাজ্য বিধানসভার নিকট জবাবদিহি করিতে হইবে, ব্যর্থ রাজ্য সরকারকে ভোটদাতারা পরবর্তী নির্বাচনে গদিচ্যুত করিবেন, এমনকী শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ সংগঠিত করিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করাও বিধেয়। কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ তাহার বিকল্প হইতে পারে না।
কিন্তু কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপের ধারাটি প্রস্তাবিত বিলের একটি ত্রুটিমাত্র। বিলটিই সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়। হিংসামাত্রেই অন্যায়, সাম্প্রদায়িক হিংসা বিশেষ ভাবে অন্যায়। কিন্তু তাহা প্রতিরোধ করিবার জন্য পৃথক আইন করিতে হইবে কেন? সত্য কথা, ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব রহিয়াছে, কালক্রমে তাহাতে নূতন হইতে নূতনতর মাত্রাও যুক্ত হইয়াছে। ইহাও অনস্বীকার্য যে, সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনকে বারংবার কলঙ্কিত করিয়াছে, ঠিক যেমন কেন্দ্রও নিষ্কলঙ্ক থাকে নাই ২০০২ সালের গুজরাত অবিস্মরণীয়, ১৯৮৪’র দিল্লিও বিস্মরণীয় নয়। কেন্দ্র হউক, রাজ্য হউক, যে সরকার যখনই সাম্প্রদায়িক হিংসা নিবারণে এবং দমনে যথেষ্ট তৎপর হয় নাই, তখনই সে রাজধর্ম হইতে বিচ্যুত হইয়াছে। সরকারের পক্ষে ইহা অত্যন্ত বড় মাপের অন্যায়, রাজধর্মে বিচ্যুত সরকারের ক্ষমতায় থাকিবার কোনও নৈতিক অধিকারই অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু রাজধর্ম বিশেষ আইন করিয়া প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে কেন? সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদের তৈয়ারি আইন-প্রস্তাবটিতে এই ধরনের হিংসা কঠোর ভাবে দমন করিবার কথা বলা হইয়াছে। কেন প্রচলিত আইনে তাহা করা যাইবে না? যদি প্রচলিত আইন যথেষ্ট কঠোর না হয়, তাহার সংশোধনের উদ্যোগই বা কেন আইনসভায় লওয়া হইবে না? আইন, প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থা, এই তিনের যথাযথ সমন্বয়ে যে কর্তব্য পালন করা উচিত, তাহার জন্য নূতন এবং স্বতন্ত্র আইনের প্রয়োজন কোথায়? সংখ্যালঘু যদি সুবিচার না পায়, তাহা ভারতীয় সংবিধানের পক্ষে চরম অপমানস্বরূপ। সংখ্যালঘুর প্রতি হিংসা বন্ধ করিবার জন্য বিশেষ আইন করিতে হইলে সেই অপমান দ্বিগুণ হয়। এবং সাম্প্রদায়িকতার ধারণাটিকে আইনের কাঠামোর মধ্যে এক ভাবে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকার পত্রপাঠ এই উদ্যোগ পরিত্যাগ করিলেই ভারতীয় গণতন্ত্রের মঙ্গল। |