গড়বেতার ছোট আঙারিয়া ‘গণহত্যা’র ঠিক ৪ দিন আগের ঘটনা।
২০০১-এর ১ জানুয়ারি। ভগবানপুরের বারুইপুরের বাসিন্দা বছর বাইশের ত্রিদিব পট্টনায়ক পটাশপুরের বড়হাট পঞ্চায়েতের কাটরঙ্কা গ্রামে পিসি-পিসেমশাইয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। বারুইপুর থেকে কাটরঙ্কা মাত্রই ৬ কিলোমিটার। সাইকেলেই পিসেমশাই দুর্গাপদ মণ্ডলের বাড়িতে পৌঁছন ত্রিদিব। তখন পটাশপুর-১ ব্লকের বড়হাট পঞ্চায়েত-সহ আশপাশের এলাকায় সিপিএম-তৃণমূলে প্রবল গোলমাল চলছিল। প্রায় রোজই বোমা-গুলির লড়াই বাধত দু’পক্ষে। সেই অশান্তির মধ্যে ত্রিদিব এসে পড়ায় তাঁকে ফিরে যাওয়ারই পরমার্শ দিয়েছিলেন পিসির বাড়ির লোকজন।
সেই মতো গ্রামের রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরছিলেন ওই যুবক। শেষ পর্যন্ত আর ফেরেননি। অভিযোগ, সেই সময়ে সিপিএমের গুলিতে নিহত হন ত্রিদিব। কাটরঙ্কা গ্রামেই ঘটে যায় সেই হত্যাকাণ্ড। তার পর দেহটি বড়হাটেরই পুরুলিয়া, নীলপুর হয়ে তুপচিবাড়ে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ। সেখানেই দেহটি মাটিতে পুঁতে অপরাধের প্রমাণ লোপের চেষ্টা হয় বলে সন্দেহ। এ দিকে, ছেলে বাড়ি না ফেরায় পেশায় দমকলকর্মী অখিল পট্টনায়ক পটাশপুর থানায় আসেন ‘নিখোঁজ’ ডায়েরি করতে। যেহেতু পটাশপুর থানা এলাকায় এসেই ‘নিখোঁজ’ হয়েছিলেন ত্রিদিব, তাই সেখানেই ডায়েরি করতে চেয়েছিলেন অখিলবাবু। কিন্তু থানা ডায়েরি নেয়নি বলে অভিযোগ। পরে ভগবানপুর থানায় ‘নিখোঁজ’ ডায়েরি করেন অখিলবাবু। ইতিমধ্যে তাঁর কাছে এ খবরও আসে, যে ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। সে নিয়ে পটাশপুর থানায় ফের অভিযোগ জানাতে এলেও প্রত্যাখ্যাত হন বলে দাবি অখিলবাবুর। এর পর তিনি সিপিএম নেতাদের কাছেও যান ছেলের সন্ধান, পারতপক্ষে মৃতদেহ হাতে পাওয়ার আশায়। অভিযোগ, সিপিএম নেতারা অখিলবাবুর কোনও কথাতেই কর্ণপাত করেননি।
ত্রিদিব বা তাঁর সাইকেলের আর সন্ধান মেলেনি।
রাজ্যে পালাবদলের সম্ভাবনা উসকেও কয়েক মাস পরের বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যস্ত হয় তৃণমূল। প্রবল ভাবেই ক্ষমতা ধরে রাখে সিপিএম। পটাশপুর অঞ্চলে শাসক-শিবিরের বিরুদ্ধে ভোটের আগে ওঠা নানা অভিযোগই ধামাচাপা পড়ে যায়।
দশ-দশটা বছর চলে যায় নিস্তরঙ্গ ভাবে। চলতি বছরের বিধানসভা ভোটে শেষ পর্যন্ত পালাবদল হয়েছে রাজ্য-রাজনীতিতে। সে বার পর্যুদস্ত তৃণমূলই এ বার মহাকরণ দখল করেছে। আর তার পর থেকেই অতীতের নানা ধামাচাপা ঘটনায় পর্দা সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। জুনের গোড়ায় পশ্চিম মেদিনীপুরের গড়বেতা-৩ ব্লকের দাসেরবাঁধ থেকে হাড়গোড় উদ্ধারের পরেই যেমন ন’বছর আগে কেশপুরের পিয়াশালায় ঘটে যাওয়া ‘গণহত্যা’র মামলা নতুন করে শুরু হয়েছে, তেমনই বৃদ্ধ অখিলবাবুর মতো অনেকেই স্বজন হারানোর বিচারের আশায় নতুন করে বুক বেঁধেছেন।
গত ১০ জুন পটাশপুরের সেই বড়হাটেরই তপন মোড়ে তিন সিপিএম নেতা-কর্মীকে আটক করে তৃণমূল কর্মীরা ত্রিদিবের কী হয়েছিল জানতে চায়। সিপিএম নেতা মধুসূদন মাইতি, পার্টি-ঘনিষ্ঠ দুই প্রাথমিক শিক্ষক বাবলু খাঁড়া, অনন্ত মাইতিকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসাবাদের পিছনে ছিল ত্রিদিব-কাণ্ডে তাঁদের প্রত্যক্ষ যোগের সন্দেহ। পুলিশ সে দিন জনতার হাত থেকে ওই তিন সিপিএম নেতা-কর্মীকে থানায় নিয়ে আসে। জেরা শুরু করে (পরে গ্রেফতারও করে)। অখিলবাবুও পটাশপুর থানায় এসে খুন ও লাশ লোপাটের অভিযোগ দায়ের করেন ধৃত তিন জন-সহ মোট ১৩ সিপিএম নেতা-কর্মীর নামে। গত অগস্টে মধুসূদন, বাবলু ও অনন্ত জামিন পান। তার পরেই অভিযুক্ত কিন্তু ‘ফেরার’ বাকি ১০ সিপিএম নেতা-কর্মী আগাম জামিনের জন্য আবেদন করেন হাইকোর্টে। তাঁদের মধ্যে ৫ জনসিপিএমের অমর্ষি লোকাল কমিটির সম্পাদক অমরেন্দ্রনাথ বারিক, প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান (অমর্ষি ২) নিরঞ্জন সুকাই, ডিওয়াইএফআই নেতা নাড়ুগোপাল মাইতি, স্থানীয় নেতা শ্যামাপদ পট্টনায়ক এবং বড়হাট হাইস্কুলের করণিক তথা পার্টি-ঘনিষ্ঠ বিনয় আদকের আগাম জামিনের আবেদন মঙ্গলবার মঞ্জুর করেছে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
কিন্তু বাকি ৫পটাশপুর-১ পঞ্চায়েত সমিতির ভূমি কর্মাধ্যক্ষ তথা নৈপুর হাইস্কুলের পার্শ্বশিক্ষক প্রবীর আদক, সমিতির বিদ্যুৎ কর্মাধ্যক্ষ তথা সিংদা জোনাল সদস্য তাপস বাঁকুড়া, সমিতির সদস্য তথা প্রাথমিক শিক্ষক পঙ্কজ সাউ, ডিওয়াইএফআই নেতা রতিকান্ত মাইতি এবং পার্টি-ঘনিষ্ঠ প্রাথমিক শিক্ষক সুধাংশু দাসের আগাম জামিনের আবেদন হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। এই ৫ জনকে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে জেরা করা প্রয়োজন বলেও মত ডিভিশন বেঞ্চের। দশ বছর আগের ‘ধামাচাপা’ মামলায় এখন ‘ফেরার’ ওই ৫ সিপিএম নেতাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। আর অখিলবাবু বিচারের অপেক্ষায়। |