বুধবার সকাল। আচমকাই কলকাতা হাইকোর্ট চত্বর জুড়ে জোরদার তল্লাশিতে নামে পুলিশ। হাইকোর্ট চত্বরে পার্ক করা গাড়িগুলি পরীক্ষা করা শুরু হয়। যে সব গাড়ি এ দিন ওই চত্বরে যাতায়াত করেছে, সেগুলিও তল্লাশি করে পুলিশ। তল্লাশি করা হয় হাইকোর্ট এলাকার বিভিন্ন খাবার দোকান ও তার আশপাশও।
অথচ, মঙ্গলবার এই ব্যস্ততা ছিল না। সোমবারেও না। বুধবার সকালে দিল্লি হাইকোর্টের সামনে বোমা বিস্ফোরণের অব্যবহিত পরেই হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন কলকাতা শহরের নিরাপত্তার রক্ষকেরা। এ দিনই যে সময়ে হাইকোর্ট চত্বর জুড়ে এই চিরুণি তল্লাশি চলছিল, সেই সময়ে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর বা নিউ মার্কেট এলাকা ছিল অন্য দিনের মতোই অরক্ষিত। প্রশ্ন উঠেছে, দিল্লি হাইকোর্টের সামনে না হয়ে বুধবারের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা যদি মুম্বইয়ের জাভেরি বাজার বা চেন্নাই সেন্ট্রাল স্টেশনে ঘটত, তা হলে কলকাতা হাইকোর্টের বদলে তল্লাশি কি তখন শিয়ালদহ স্টেশন বা নিউ মার্কেটের সামনে হত? তখন হাইকোর্ট কি অরক্ষিত থেকে যেত? |
অভিযোগ, সাম্প্রতিক কালে কলকাতা শহরের নিরাপত্তার দস্তুর সে রকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য শহরে কোনও ধরনের বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গেই আচমকা শুরু হয় তৎপরতা। মেটাল ডিটেক্টর, পুলিশের গাড়ি, র্যাফ, খানা-তল্লাশির এই রমরমা চলে দিন কয়েক। আবার ঝিমিয়ে পড়ে সব তৎপরতা। কলকাতা ফিরে যায় আগের অবস্থায়। বুধবার দিল্লির ওই ঘটনার পরে তৎপরতার সেই বহরটাই দেখা গেল হাইকোর্ট চত্বরে। ঠিক যেমন দেখা গিয়েছিল, এই বছরের ১৪ জুলাই, মুম্বই বিস্ফোরণের পরে।
বুধবার সন্ধ্যায় হাইকোর্ট চত্বর এলাকায় এই নিরাপত্তা নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কলকাতা পুলিশের বড় কর্তারা বৈঠকও করেছেন। হঠাৎই নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে, এ কথা মানতে চাননি কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) জাভেদ শামিম। তাঁর কথায়, “শহরের বিভিন্ন এলাকায় সারা বছরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকে। তা আরও বাড়ানো হয়েছে মাত্র।” পুলিশের একটি সূত্র বলছে, হাইকোর্ট এলাকায় গাড়ি পার্কিং নিয়ে সমস্যা রয়েছে। এত দিন ধরে অরক্ষিত অবস্থাতেই পড়ে থাকত অতগুলি গাড়ি। পুলিশের অভিযোগ, হাইকোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা ও পার্কিং নিয়ে কড়াকড়ি করতে গেলে আইনজীবীরা আপত্তি করেন। মাস খানেক আগে এ নিয়ে সমস্যাও হয়েছিল।
বুধবার হাইকোর্ট চত্বরের মতো নিরাপত্তার এই কড়াকড়ি চোখে পড়েনি শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। দুপুরে কালীঘাট মন্দির চত্বরে গিয়ে দেখা যায় ক্যাম্প করে পুলিশ অফিসারেরা বসে রয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মন্দিরে ঢোকার মুখে তল্লাশির ব্যবস্থা নেই। মন্দিরের গাইড রাসবিহারী দাস জানিয়েছেন, গত কয়েক মাস ধরেই পুলিশ সেখানে থাকছে। মন্দিরের পাণ্ডা শম্ভু ঝা এ দিন সকাল থেকে পুলিশের তৎপরতা দেখতে পাননি। তিনি বলেন, “সবকিছুই অন্যদিনের মতোই চলছে।”
নিরাপত্তার কড়াকড়ি খানিকটা বেড়েছে কলকাতা বিমানবন্দরে। রাস্তার মাঝে গাড়ি দাঁড় করিয়ে তল্লাশি শুরু হয়েছে। এর আগেও এমন তল্লাশি হয়েছে। কয়েকদিন পরে আবার বন্ধও হয়ে গিয়েছে। বিমানবন্দরের ভিতরে কোনও তল্লাশি ছাড়াই হাতে ব্যাগ বা স্যুটকেস নিয়ে যাত্রী বা দর্শনার্থী যে কোনও সময়ে ঢুকে যেতে পারেন। গেটের সামনে ব্যাগ বা দেহ-তল্লাশির কোনও ব্যবস্থা নেই। বুধবার কলকাতা বিমানবন্দরের অধিকর্তা বি পি শর্মা বলেন, “প্রতিটি গেটে মেটাল ডিটেক্টর বসানো আছে। বিস্ফোরক নিয়ে ঢোকার সময়ে তার সতর্ক করার কথা।” বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি হলেও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থী ঢোকা বারণ হয়নি।
বুধবার সকালে দিল্লিতে বিস্ফোরণের পরেই কলকাতা পুলিশ দাবি করেছে, মেট্রোয় নজরদারি বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও খাতায়-কলমে চিত্রটা ভিন্ন ছিল। এ দিন দুপুর ও বিকেলে রবীন্দ্রসদন, কালীঘাট, রবীন্দ্র সরোবর, সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনের ছবিটা অন্য দিনের মতোই ছিল। ঢোকার মুখে চেয়ারে বসে থাকা জনা দুয়েক পুলিশকর্মী, টিকিট কাউন্টারের কাছে মেটাল-ডিটেক্টর গেটে আরও জনা দুয়েক কর্মীর তৎপরতায় বিশেষ ফারাক চোখে পড়েনি। প্ল্যাটফর্ম জুড়ে যেমন রেলের নিরাপত্তাবাহিনীর জওয়ানেরা টহল দেন, এ দিনও তাই ছিল। যদিও পুলিশের দাবি, বুধবার সকাল থেকে মেট্রোর নিরাপত্তার জন্য ৪৬৯ কর্মী-অফিসার মোতায়েন করা হয়েছে।
এ দিন ফের চাঙ্গা করা হয় রেল সুরক্ষা ব্যবস্থাকেও। রেল পুলিশের সূত্রের খবর, সতর্কতা মিলতেই অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয় বিভিন্ন স্টেশন চত্বরে। সন্দেহজনক ব্যাগ দেখলেই খুলে পরীক্ষা করছেন জওয়ানেরা। বিভিন্ন ট্রেনে পুলিশ কুকুর দিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। মুম্বই বিস্ফোরণের পরদিনও একই ব্যবস্থা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ যাত্রী জানিয়েছেন, তার কয়েক দিন পরেই সেই ব্যবস্থা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে গিয়েছিল। যদিও,পুলিশ এই অভিযোগ মানতে নারাজ। |