দলের নামে তোলা আদায়, জমি-বাড়ির বিবাদে অন্যায্য হস্তক্ষেপ-সহ নানা অপকর্ম করা হচ্ছে বলে লিফলেট বিলি করে সতর্ক করেছিলেন বর্ধমান শহরের কিছু তৃণমূল নেতা-কর্মী। নালিশ জানাতে দু’টি টেলিফোন নম্বরও দেওয়া হয় লিফলেটে। কিন্তু ‘উচ্চতর’ নেতৃত্ব যে এই পদক্ষেপ অনুমোদন করছেন না, তা বুধবারই স্পষ্ট হয়ে গেল।
সোমবার মিছিল করে ওই লিফলেট বিলি করা হয়েছিল। লিফলেট দেওয়া হয়েছিল ‘বর্ধমান শহর তৃণমূল কংগ্রেস কমিটির সভাপতি’ সমীর রায়ের নামে। বিষয়টি জানতে পেরেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন স্থানীয় বিধায়ক তথা কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়-সহ বহু তৃণমূল নেতা। বুধবার সাংবাদিক সম্মেলন করে রবিরঞ্জনবাবু শহর তৃণমূলের যে নতুন কমিটি, তার সভাপতি তিনি নিজেই। সমীরবাবুর সেই কমিটিতে ঠাঁই হয়নি।
সমীরবাবুদের দেওয়া লিফলেটে বলা হয়েছিল:
১) তৃণমূল নামধারী কোনও ব্যক্তি দলের লিখিত অনুমতি ব্যতিত অন্যায় ভাবে অর্থ দাবি করলে তা দেবেন না এবং অবিলম্বে তা নিম্নলিখিত ঠিকানায় (৭২, আর বি ঘোষ রোড, খোসবাগান, বর্ধমান) জানান।
২) জমি, বাড়ি বা পারিবারিক বিবাদ সংক্রান্ত ব্যাপারে দলের কেউ অন্যায় ভাবে নাগরিক জীবনে হস্তক্ষেপ করলে দলকে তা অবশ্যই জানান।... এলাকায় সুষ্ঠু পরিবেশ ও শান্তি বজায় রাখতে ভদ্র ও সৎ তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে সক্রিয় সহযোগিতা করুন।
দলের নামে কেউ টাকা চাইলে তা দিতে বারণ করেছেন খোদ তৃণমূল নেত্রীই। কিন্তু সিপিএমের বিরুদ্ধে দলবাজি ও সর্বক্ষেত্রে নাক গলানোর যে অভিযোগ দীর্ঘদিন ছিল, বর্তমান শাসকদলের বিরুদ্ধেও কার্যত তা-ও তোলা হয়েছে লিফলেটে। ‘কিছু ছদ্মবেশী তৃণমূল কর্মী এবং সিপিএম থেকে আগত কিছু ব্যক্তি নীতি-আদর্শের পরিপন্থী ও অসামাজিক কাজকর্ম করে দল ও নেত্রীকে মানুষের চোখে হেয় করতে চাইছে’ বলেও তাতে অভিযোগ করা হয়।
সম্প্রতি বর্ধমানে একের পর এক গোষ্ঠী সংঘর্ষে জেরবার তৃণমূল। অপর গোষ্ঠীর উপরে হামলা এবং শহরে সশস্ত্র মিছিল করায় বহিষ্কারও করা হয়েছে পাঁচ জনকে। সমীরবাবুদের লিফলেট সে দিক দিয়েও ইঙ্গিতপূর্ণ। লিফলেটে যে দু’টি ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে, দু’টিই খোসবাগানে সমীরবাবুর অফিসের। যদিও মঙ্গলবার তার একটি বন্ধ ছিল। অপরটিতে ফোন করা হলে খোসবাগানের অফিসের যে কর্মী ধরেন, দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সে ব্যাপারে তাঁদের কী করণীয় তা তিনি বলতে পারেননি। |
এ প্রসঙ্গে সমীরবাবু বলেন, “কয়েক জন কর্মীকে ফোন ধরতে বলা হয়েছে। হয়তো এখনও ওঁদের রপ্ত হয়নি। কোনও কর্মীর বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ এলে আমরা গিয়ে দেখব, প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেব।” কিন্তু আপনি তো পদাধিকারীই নন? মঙ্গলবার রাতেও সমীরবাবুর জবাব ছিল, “কে বলেছে? এখনও আমিই শহর তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি!” আর এ দিন তিনি বলেন, “আমি এই কমিটি সম্পর্কে কিছুই জানি না। দলের তরফে আমাকে কিছু জানানো হয়নি।”
কিন্তু বাস্তব হল, ‘পরিস্থিতি’ পাল্টে গিয়েছে। কলকাতা থেকে বর্ধমানে এসে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রবিরঞ্জনবাবু। প্রশ্ন উঠেছে সমীরবাবুর এক্তিয়ার নিয়েই। মঙ্গলবারই কলকাতা থেকে টেলিফোনে মন্ত্রী বলেছিলেন, “উনি এখন আর শহর তৃণমূলের সভাপতি নন। লিফলেটের বয়ানও যথেষ্ট আপত্তিকর। আমি রাজ্য নেতাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব।”
তৃণমূলের শহর যুব কমিটির সভাপতি খোকন দাসও বলেন, “নতুন শহর কমিটিতে ওঁর নাম নেই। তা সত্ত্বেও কমিটির সভাপতি পরিচয় দিয়ে এ রকম লিফলেট বিলি করালেন কী করে? এতে তো তৃণমূলের সমস্ত কর্মীকেই হেয় করা হল!”
সমীরবাবু অবশ্য পাল্টা বলেন, “সব কর্মীকে আদৌ হেয় করা হয়নি। তা হলে সৎ তৃণমূল কর্মীদের কথা বলা হত না। ইদানীং দলে প্রচুর বেনোজল ঢুকেছে, বিশেষত সিপিএম থেকে। মূলত তাদের অপকর্ম সম্পর্কেই আমরা মানুষকে সতর্ক করতে চাইছি।” তাঁকে ছেঁটে ফেলা হল কেন? রবিরঞ্জনবাবুর আশ্বাস, “বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য করে শহরের উন্নয়নে আমরা ওঁর অভিজ্ঞতা ব্যবহার করব।”
পদে না থাকায় সমীরবাবুর পক্ষে ‘ব্যবস্থা নেওয়া’ আর সম্ভব নয় ঠিকই, কিন্তু তাঁর অভিযোগের সত্যতা কি পদাধিকারীরা মানছেন? রবিরঞ্জনবাবুর দাবি, “বর্ধমানে দলের অন্দরে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের খবর কাগজে দেখেছি। কিন্তু কেউ তোলা তুলছে বা সামাজিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে, এমন অভিযোগ পাইনি।” তাঁর খেদ, “অভিযোগ থাকলে উনি দলের ভিতরে বলতে পারতেন। আমাদের কারও সঙ্গে কথা না বলে লিফলেট ছাপিয়ে জনতার কাছে বিলি করতে গেলেন কেন?” |